রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে দেশভাগের পালায় ১৯৪৭ সালে তথাকথিত পবিত্রস্থানের কুশীলবদের প্রথম থেকেই বাঙালি জাতির ওপর খড়্গহস্ত হতে দেখা যায়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক—সর্বক্ষেত্রেই তারা শোষণ, বঞ্চনা, প্রাণঘাতী অত্যাচার, অমানুষিক নিপীড়নে জর্জরিত করে তোলে বাংলার মানুষকে। বাংলার বদলে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। সোনার বাংলার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস/ আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’—সেই বাঁশির সুর তারা থামিয়ে দিতেও পিছপা হয় না। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিদারদের বুকে গরম সিসার গুলিতে ঢাকা রাজপথ শুধু রক্তাক্ত করেই দিয়ে থেমে থাকেনি, তারা সাধারণ মানুষের ওপর দিনের পর দিন দানবীয় আক্রমণ বাড়াতে থাকে। সবচেয়ে বড় ও চরম আঘাত হানা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে অপারেশন সার্চলাইট নামে। পরিকল্পিতভাবে সারস্বত সমাজসহ নির্বিচার ‘গণহত্যা’ করে সোনার বাংলাকে ধ্বংস করার মরণখেলায় প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু বাংলার মানুষ ভীত-মেরুদণ্ডহীন নন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিব রাঙা প্রভাত’-কে শপথবাক্য করে রুখে দাঁড়ান। শুরু হয় ঘরে-বাইরে মরণপণ লড়াই। সর্বশক্তি দিয়ে স্বাধীনচেতা বাংলার মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে নামেন। পাশে বন্ধু হিসেবে পান ভারতকে। প্রায় ৯৯ লাখ শরণার্থীকে সীমান্তের ওপারে ভারত আশ্রয় দেয়। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। হাতে হাত রেখে পায়ে পা মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী এগিয়ে গেছে মুক্তির সন্ধানে। শুধু তা-ই নয়, বাস্তবের মাটিতে যুদ্ধক্ষেত্রে এই যৌথ অভিযান এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করে। একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হলো। সেই সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধের ঘোষক দাম্ভিকের দর্পচূর্ণ করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ করে। ৩০ লাখ মানুষের আত্মবলিদান—কবির ভাষায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ এল স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে, তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। এরপর পাঁচ দশক পার হয়ে এসেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকে গবেষণামূলক কাজ করেছেন। তবু অনেক কাজ রয়ে গেছে বাকি। যত দিন যাচ্ছে, ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শীদের আমরা হারাচ্ছি। বিলম্বে ইতিহাস বিকৃতি বা ভ্রান্তি ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর ইতিহাস এবং তার চেতনাকে তুলে ধরতে মুক্ত আসর ও স্বপ্ন ’৭১ আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছে। তাদের কাজের সাথি হয়ে ইতিহাস অনুসন্ধানে হৃদয়ের বন্ধনে: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নদীয়া গ্রন্থ রচনার এই প্রয়াস। প্রতিবেশী দুই দেশ—ভারত ও বাংলাদেশ। সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার নিগড়ে বাঁধা দুটি দেশ। ‘আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল’, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই শুধু একটি আন্দোলন নয়, বাঙালির পরিচয়গৌরবের একই প্রতিজ্ঞায় উদ্ভাসিত মানবিক মূল্যবোধের সম্মিলিত পদচারণ। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা তারই একটি অকৃত্রিম অংশ। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নদীয়ার ভূমিকা, পারস্পরিক মেলবন্ধন, ঘটনাপরম্পরা, সুখ-দুঃখের টানাপোড়েন, অপ্রকাশিত ইতিহাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের মাধ্যমে তুলে আনার প্রচেষ্টা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই কাজে দুই বাংলার বহু মানুষ সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন। মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশনের প্রকাশক বন্ধু আবু সাঈদ গভীর ভালোবাসায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসারে নিজের কর্তব্যে অবিচল থেকে এই গ্রন্থ প্রকাশে এগিয়ে এসেছেন। তাঁকে শুধু ধন্যবাদ দিলে অন্যায় হবে। আবু সাঈদ এবং মুদ্রণ প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত তাঁর সহযোগীদের কাছে আমি ঋণী। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের উদ্যাপনকালে প্রকাশিত হৃদয়ের বন্ধনে: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নদীয়া গ্রন্থটি আপামর পাঠকের কাছে সমাদৃত হলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থকতা লাভ করবে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরজীবী হোক।