প্রিয় বাবা, কেমন আছো বাবা? মা কেমন আছেন? দাদুর শরীরটা ভালো আছে তো? ঠিকমতো ঔষধ খান? নাকি আগের মতো এখনও জোর করে ওষুধ খাওয়াতে হয়। উফ! এই মানুষটাকে ওষুধ খাওয়ানো যে কী যন্ত্রণা, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেতাম। বয়স হয়েছে তবুও বাচ্চাদের মতো সব কাণ্ড করে বসতেন। আমার কিন্তু মন্দ লাগতো না। অনেক দিন হলো তোমাদের কাউকে দেখি না বাবা। কত দিন হবে? উমম বছর সাতেক তো হবেই। আচ্ছা কাব্য কেমন আছে? বড় হয়ে গেছে অনেক, তাই না? স্কুলে ভর্তি হয়েছে নিশ্চয়ই। ঠিকমতো স্কুলে যায় তো? বাসায় এসে পড়তে বসে নাকি ভাইয়ার মতোই ফাঁকিবাজ হয়েছে? অবশ্য এখন ফাঁকিবাজ হওয়ার সুযোগ কোথায় বলো? এখন তো তুমি আছো। তোমার মতো একজন বিচক্ষণ মস্তিষ্কের অধিকারী আর্মি রিটায়ার্ড অফিসারের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কী এত সোজা? উহুম। কক্ষনো না। জানো বাবা! তোমাকে, মাকে, দাদুকে, ভাইয়া-ভাবি, কাব্য তোমাদের সবাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে আমার। খুব। এই অস্থির মনটা সারাক্ষণ কারণে-অকারণে বড্ড ছটফট করে তোমাদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। বড্ড। সেই মনকে আমি লোহার শিখল দিয়ে বেঁধে রাখতে চাই। কিন্তু পারি না। আজকাল কেন আমার এমন হচ্ছে বলো তো? মনে হচ্ছে আমি নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছি। তা না হলে যারা আমাকে খুব কাছ থেকে কোনো ধারালো অস্ত্র ছাড়াই তিলে তিলে কুপিয়ে হত্যা করলো, ভিতর থেকে একদম নিঃস্ব বানিয়ে ছাড়লো, একেবারে শেষ করে দিলো আমাকে, তাদের জন্য কেন আমার মন কাঁদবে? কেন? কোনো এক আলো রাঙা বিষণœ স্যাঁতসেঁতে বিকেলে তোমার পছন্দের যোগ্য রাজকুমারের হাতে তুলে দিয়েছিলে তোমার একমাত্র আদরের রাজকন্যাকে। কিন্তু তোমার সেই যোগ্য, উচ্চশিক্ষিত, সুদর্শন রাজকুমারের বিশাল সাম্রাজ্যে কী একদিনের জন্যও আমি সুখি হতে পেরেছিলাম বাবা? পারিনি। কীভাবে পারবো বলো? একটি মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা যে সমান পাপ বাবা। আর সেই পাপ কাজটাই তুমি আমাকে দিয়ে করালে। কেন এমনটা করেছিলে বাবা? তোমার মিথ্যা আভিজাত্যের অহংকার আর ক্ষমতার দাপট বজায় রাখতে গিয়ে সেদিন একটি নিষ্পাপ ছেলের হৃদয় যে আমি খুব যতœ সহকারে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়েছিলাম। শেষ করে দিয়েছিলাম তার সমস্ত অনুভ‚তিকে। পায়ে পিষে ধুলোমাখা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলাম তার আকাশ সমান ভালোবাসা। এতটা পাপ করার পরও কীভাবে আমি সুখি হতাম বলো? পাপ কী কাউকে ছেড়ে দেয়? ছাড়ে না বাবা। হয়তো আমাকেও ছাড়েনি। আমার আত্মার মৃত্যু তো সেদিনই হয়েছিল বাবা, যেদিন আমি নতুন জীবন শুরু করার লোভে স্বার্থপরের মতো শ্রাবণকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে এসেছিলাম। মৃত আত্মা নিয়ে পৃথিবীতে কেউ কী সুখী হতে পেরেছে বাবা? শুনেছো কখনো? না বাবা, পারেনি। তাইতো আমিও সুখি হতে পারলাম না। জানো বাবা! সেদিন শ্রাবণ আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটি বারবার বলেছিলো, ‘আমাকে ছেড়ে যেও না প্রিয়ন্তি। আমি পাগল হয়ে যাবো, নিঃস্ব হয়ে যাবো। দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো প্রিয়ন্তি। তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে একা একা আমি নিঃশ্বাস নিতে পারবো না। এই দেখো, এই দেখো প্রিয়ন্তি আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে প্রিয়ন্তি। খুব কষ্ট। প্লিজ যেও না আমাকে ছেড়ে। যেও না।’ বলতে বলতে ছেলেটি হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। একটা পুরুষ মানুষের কান্না যে কতটা ভয়ংকর শোনায় সেটা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না বাবা। পারবো না। জানো বাবা, সেদিন ইচ্ছে হয়েছিলো ওর হাত ধরে অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। অনেক দূরে। যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। কোনো কাকপক্ষীও না। কিন্তু শেষ অব্দি গিয়ে আমি পারলাম না। মেয়ে হয়ে বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে এই নিষ্ঠুর কাজটি আমি করতে পারিনি বাবা। তোমার সম্মান রক্ষা করতে সেদিন একটি ছেলেকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছিলাম আমি। আর তুমি? তুমি আমার সুখের জন্য মিথ্যা অহংকার আর আভিজাত্যের মায়া ছাড়তে পারলে না বাবা! তুমি বড় স্বার্থপর বাবা। বড় স্বার্থপর। তুমি কী জানো তোমার সেই যোগ্য রাজকুমার রোজ নেশা করে টলতে টলতে এসে আমার গায়ে হাত তুলতো! মানুষটা পর নারীতে আসক্ত ছিল বলে একদিন স্ত্রীর দাবি নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম। সেদিন তোমার গুণধর জামাই কী করেছে জানো? থাক, তোমাকে বলবো না। কারণ কোনোদিন তুমি আমার দুঃখ কষ্ট বুঝোনি। আজ কীভাবে বুঝবে! তুমি তো কখনো বুঝতেই চাইলে না কীসে আমি সুখী হবো। চিরদিন শুধু নিজের কথাটাই ভেবেছো বাবা। নিজের সম্মানের কথা ভেবেছো। আচ্ছা এই যে তোমার মিথ্যা আভিজাত্যের অহংকার, ক্ষমতার দাপট এগুলো কী এখন তোমার জীবনে আমার শূন্যতা পূরণ করতে পেরেছে? বাবা বলে ডাক দিয়ে তোমার হৃদয় শীতল করতে পারে? বলো, পারে? হাহাহা। আমি জানি বাবা। আমি জানি, তুমি নিঃস্ব হয়ে গেছো। ভিতর থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে গেছো। বাবা, ও বাবা! কেন এমনটা করেছিলে আমার সাথে? কেন বাবা? কেন? আজ সুখী হওয়ার পরিবর্তে কেন এই নরক যন্ত্রণায় পুড়তে হচ্ছে আমাকে? যে মানুষটা তার সমস্ত হৃদয় উজাড় করে আমাকে ভালোবাসতো, আগলে রাখতো, কেন তার সাথে আমাকে সুখী হতে দিলে না? কেন বাবা? প্রতিটি বাবা তো মেয়ের সুখ চায়, শান্তি চায়। তুমি কেন চাইলে না? কেন বুঝতে চাইলে না কীসে আমি সুখি হবো, কীসে আমি শান্তি পাবো? ও বাবা তোমাকে একটা কথা বলি শুনবে? বলবো? খুব গোপন কথা, খুব। তোমাকে ভীষণ আনন্দ দিবে। বাবা শ্রাবণ আর বেঁচে নেই। আমার বিয়ের সপ্তাহখানেক পরে ছেলেটি আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজটি করেছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে ও চলে গেছে। শুনতে পাচ্ছো বাবা, ও আর বেঁচে নেই। চলে গেছে অনেক দূরে। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আসবে না ফিরে। অথচ দেখো, এখনও আমি নির্লজ্জের মতো বেঁচে আছি। তুমি একটা খুনি বাবা। ভয়ংকর খুনি। ভালোবাসার অপরাধে একটি নিষ্পাপ ছেলেকে তুমি আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে বাধ্য করেছো। আমার দৃষ্টিতে তুমি খুনি পিতা। খুনি। আমি কোনোদিন তোমাকে ক্ষমা করবো না। কোনোদিনও না। আমি কোথায় আছি, কেমন আছি এগুলো জানতে চাওয়ার মতো ভুল কোনোদিন করো না। কোনোদিন আমাকে খোঁজার চেষ্টাও করো না। তবে আমি মরবো না। বেঁচে থাকবো। বেঁচে থেকে মেয়ে হারানোর যন্ত্রণা তোমাকে তিলে তিলে অনুভব করাবো। এটাই তোমার শাস্তি। মনে রেখো, তোমার কাছে, তোমাদের কাছে আমি মৃত। ভেবে নিও তোমাদের হৃদয়ে আমার জীবন্ত দাপন হয়ে গেছে। আজ আর দীর্ঘ করবো না। ভালো থেকো বাবা। মায়ের যতœ নিও। দাদুকে দেখে রেখো। এই মানুষটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। ভাইয়া-ভাবি, কাব্য সবাইকে নিয়ে ভালো থেকো। সুখে থেকো। আল্লাহ হাফেজ। ইতি তোমার অর্ধমৃত মেয়ে প্রিয়ন্তি।