রবীন্দ্রনাথের পরেই কবিতায় যে-বহুমুখী প্রতিভার নাম করতে পারি আমরা, তিনি নজরুল ইসলাম। বৈপরীত্যকে আর-কোনো বাঙালি কবি এমন একসঙ্গে আমন্ত্রণ জানাননি। উত্তাল আবেগের কবিতা, সূক্ষ্মতম ইন্দ্রিয়অনুকম্পনের কবিতা, ব্যঙ্গ-তীক্ষè কবিতা; সামাজিক কবিতা, প্রেমিক কবিতা, লিরিক কবিতা, নাটকীয় কবিতা, কাহিনীকাব্য―একজন কবি জীবনের কবিতাকে এক বিরাট অর্কেস্ট্রার মতো ধারণ করেছেন। কত বিচিত্র বিপরীত বিরোধী কবিতা তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে আসে : ‘বিদ্রোহী’ (অগ্নি-বীণা), ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ (বিষের বাঁশী), ‘পূজারিণী’ (দোলন-চাঁপা), ‘আপন-পিয়াসী’ (ছায়ানট), ‘রৌদ্র-দগ্ধের গান’ (ছায়ানট), ‘ইন্দ্রপতন’ (চিত্তনামা), ‘সাম্যবাদী’ (সাম্যবাদী), ‘প্যাক্ট’ (চন্দ্রবিন্দু), ‘ভাঙার গান’ (ভাঙার গান) প্রভৃতি। অতি পরিচয়ের ফলে এই কবিতাগুলি-যে পরস্পরের কত বিরোধী ও বিপরীত, তা আমাদের নজরে পড়ে না।... কবিতার বাইরেও তাঁর বিরাট বিচিত্রতাও নিশ্চয় অবিস্মরণ দ্যুতিময়। তাঁর গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ চর্চা; পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনা; অভিনয় ও চলচ্চিত্র পরিচালনা; গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও বক্তা হিশেবে দক্ষতা―সমস্ত মিলেই নজরুল। বিশেষ করে তাঁর গানের কথা বলব, যে-গানের অনেকগুলি কবিতা হিশেবেই বিবেচ্য, এবং যে-গানের বিষয় ও সুরের বিচিত্রতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতিকারদের তুল্য। না-মেনে উপায় নেই, রবীন্দ্রনাথের পরে আর-কোনো লেখকের মধ্যে এত বিচিত্র বিষয়ে এত বিপুল সাফল্য অর্জিত হতে দেখা যায়নি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ (৩ আগস্ট ১৯৪৩ - ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য-সম্পাদক। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের "পোয়েট ইন রেসিডেন্স" ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশক থেকে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে তার গবেষণাধর্মী অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের উপর তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম রয়েছে। তিনি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বেগম রোকেয়া, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককে নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যমহলে তিনি 'মান্নান সৈয়দ' নামেই পরিচিত ছিলেন।