'ইমরানের রাগ-অনুরাগ আমাদের সবার' সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমি নিজে কিন্তু কখনো কবিতা লিখিনি। বলা যায় সাহস করিনি লিখতে। মনে হয়েছে কাজটা খুব কঠিন; আমার জন্য দুঃসাধ্য। ছন্দের সমস্যা আছে, মুক্ত ছন্দে বা গদ্যের আকারে লিখলেও ছন্দস্পন্দ দরকার হবে, যেটা অনেকটা গানের মতো; গানের গুণ না থাকলে কোনো রচনাই কবিতা হয় না। প্রয়োজন হয় গভীর অনুভূতির, নতুন চিন্তার। চিন্তার ওই আবশ্যকতার বিষয়টা অনেকেই ভাবেন না। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো কবিতাই সার্থক হয়নি যার ভেতর চিন্তা নেই। আর কেবল এসব জিনিস একত্র করতে পারলেই যে কবিতা সৃষ্টি হয়ে যাবে তা নয়; এদের সবগুলো মিলে একটি প্রাণবন্ত নতুন জিনিস দাঁড়িয়ে গেলে তবেই বলা যাবে, হ্যাঁ, কবিতা পাওয়া গেছে। অনেকেই কবিতা লেখেন। প্রচুর কবিতার বই অহরহ, হরহামেশা বের হচ্ছে; কাব্য যশের এই প্রার্থীদের চেষ্টা দেখে মনে হয় তারা খুবই সাহসী। তাদের অধিকাংশেরই সাহসের প্রশংসা করা যায়, কবিতার প্রশংসাটা বাদ দিয়ে। ইমরান মাহফুজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। তার সাহস এবং রচনা উভয়েই সাহসের দাবী রাখে। দেখতে পাচ্ছি যে তার রচনাগুলোতে কবিতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় গুণগুলো উপস্থিত রয়েছে। ইমরানের প্রথম কবিতার বই দীর্ঘস্থায়ী শোকসভা। সেখানে অনুভূতি ছিল গভীর। সেটি মূলত: বেদনার। বেদনার সেই গভীর অনুভূতি তার নতুন বই কায়দা করে বেঁচে থাকো’তেও উপস্থিত। তবে এখানে যুক্ত হয়েছে রাগ। রাগটা প্রথম বইতেও ছিল, কিন্তু এখানে রাগ কিছুটা বেশী। আসলে সব রাগের পেছনেই অনুরাগ থাকে। অনুরাগ ভালোর প্রতি, আর সেই ভালো বিপন্ন হয়েছে দেখতে পেলেই রাগ উৎপন্ন হয়। ইমরান মাহফুজ চেয়েছে সুস্থ জীবন, যা আমরা সবাই চাই। কিন্তু ওই ভালোটা সে পায়নি, পাচ্ছে না। সে জন্যই তার রাগ। ওই রাগ-অনুরাগ তো আমাদের সবারই। নিজের কথা বলতে বসে এই কবি আমাদের সকলের কথাই বলেছে। শোককে সে ক্রোধে পরিণত করেছে, যেটা খুবই দরকার। তার রচনায় গানের স্পন্দন ও অনুভূতির গভীরতা রয়েছে, সঙ্গে আছে কবিতার জন্য যা অপরিহার্য সেই চিন্তা। চিন্তা করে লিখেছে, এবং চিন্তা করে দেখেছে যে জগৎটা অসঙ্গতিতে ভরপুর। অসঙ্গতি আগেও ছিল; কিন্তু তা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। অসঙ্গতিগুলো এখন বিশেষ ভাবে অসহ্য, কেননা সভ্যতা তো এগিয়েছে এবং আমাদের এই পশ্চাৎপদ দেশেও আমরা জাজ্বল্যমান নানা উন্নতি সাধন করে ফেলেছি। কিন্তু ওই যে ভয়াবহ পুরাতন সত্য সেটা মিথ্যা হয়ে তো যায়ইনি বরং আরও উৎকট রূপে বিকশিত ও প্রকাশিত হয়েছে। সত্যটি হলো এই যে উন্নতির বৃদ্ধি একা আসে না, সঙ্গে থাকে বৈষম্য। ইমরানের চিন্তা-দুশ্চিন্তার ভেতরে রয়েছে বৈষম্য বৃদ্ধির ওই ঘটনাও। তার চিন্তাধারা স্বচ্ছ। ইমরানের জানা আছে যে মূল ব্যাপারটা সামাজিক; কিন্তু এর কর্তা হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নিজেকে আড়াল করে রাখে। মনে হয় সে নিরপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্র আসলে সুবিধাভোগীদের দাসানুদাস। তার যত আইন-কানুন সবই সুবিধা করে দেয় সৌভাগ্যবানদের, বঞ্চনা আনে যারা অসফল তাদের জন্য। আইনের শাসন মানে হলো বিত্তবানদের শাসন। তার বাইরে কিছু নেই। রাষ্ট্রকে ইমরান টেনে সামনে নিয়ে এসেছে। তাকে ধিক্কার দিচ্ছে। আর আছে শ্রেণী। অনেকেই অনেক কথা বলেন, কিন্তু সাধারণত বলেন শ্রেণীকে বাদ দিয়ে, অনেক সময় আড়াল করে। শ্রেণী কী বস্তু ইমরান মাহফুজ জানে এবং সেটা সে আমাদেরকে জানাচ্ছে তার কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে। বর্তমান সমাজে মানুষের টিকে থাকাটাই কঠিন; বেঁচে থাকা তো অবশ্যই। বাঁচার জন্য নানান কায়দা-কৌশল প্রয়োগের দরকার পড়ে। ইমরান সে-কথাটাই বলছে তার লেখার মধ্য দিয়ে। কবিতার ভেতরকার ভাবই তার ভাষা ঠিক করে দেয়। ইমরানের রাগ তার ভাষার ভেতর ধরা পড়েছে এবং কবিতায় তা ভাষার নিজস্বতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে। রাগটা সাধারণ সত্য বটে, তবে রাগের ধরনটা দাঁড়ায় স্বতন্ত্র। ইমরানের রাগে স্বাতন্ত্র্য আছে। সে জন্যই তার ভাষা ভিন্ন রকমের। আমরা জানি যে উপমা ছাড়া কবিতা হয় না। ইমরানের উপমাগুলো একই সাথে প্রাণবন্ত ও যথার্থ। প্রাণবন্ততা ও যথার্থতার সমন্বয় সব সময়ে ঘটে না; ইমরানের রচনাতে সেটা ঘটেছে। এসব কিছুর পেছনে বৈদগ্ধের তৎপরতাও কিন্তু উপস্থিত। ভালো লেখার প্রধান গুণ এটা যে তা নাড়া দেয়। ইমরান মাহফুজের কবিতাগুলো নাড়া দেয়। আমাকে দিয়েছে, অন্য পাঠকদেরকেও দেবে। অভিনন্দন তাকে। এমিরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১০ জানুয়ারি ২০২০
১০ অক্টোবর ১৯৯০ খ্রি. কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে ইমরান মাহফুজের জন্ম। বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম ও মা বিলকিছ বেগম। একাডেমিক পড়াশোনা উদ্ভিদবিদ্যায়, লিখেন বাংলায়, কাজ করেন ইংরেজী দৈনিকে। গবেষনা ক্লাসিক সাহিত্যে। সম্পাদনা করেন কালের ধ্বনি। তার সম্পাদনা ও গবেষণা গ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স, মাসর্টাস ও এমফিলে পাঠ্য সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে গত ৩ বছর ধরে। লেখালেখি শুরু ২০০৫ সাল থেকে। মা মাটি মানুষকে জানতে বাংলাদেশের ৫২টি জেলা ভ্রমনসহ ভারত, নেপাল ও ভুটানে রয়েছে তার চমৎকার পদচারণা।