"এখনও রহস্য" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ শীতের এক শেষ বিকেলে আমার হাতে এলাে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৃথিবীর রহস্যময় স্থানের বিবরণ নিয়ে লেখা একটি বই। ঐ আশ্চর্য বইটি আমাকে সন্ধান দিলাে এক নতুন পৃথিবীর। আমি যেনাে পুরনাে ঢাকার ঐ ছােট্ট গলি থেকে দূর পলিনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে চলে গেলাম। বিভূতিভূষণ এক রহস্যময় লাল পােশাকপরা নাবিকের মতাে আমাকে ডাক দিলো। সোনালী ডানার চিলের পরিবর্তে আমি সমুদ্র উপকূলের গাঙচিলের ডাক যেনাে শুনতে পেলাম। এখনও আমি ঐ বইটির প্রতি কৃতজ্ঞ। যে বইটির পাতায় পাতায় আকর্ষণীয় এক ভাষায় বর্ণিত হয়েছিলাে বিভিন্ন দ্বীপ, পাথুরে গুহা, জঙ্গলের অন্ধকারে লুকিয়ে রাখা গুপ্তধনের খবর। আফ্রিকার ঘন অন্ধকারের জঙ্গলে কোন্ উপজাতি সর্দারের গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে বিশাল অ্যানাকোনডা সাপ? এতাে রহস্য ছড়িয়ে আছে আমাদের এই পৃথিবীতে! কারা বানিয়েছে চিলির অদূরে ইস্টার দ্বীপে বিশাল পক্ষীমানব সৃতি মােয়াই? কিরিবাতির দ্বীপে পাথরের উপর দৈত্য-মানুষদের বিশাল পায়ের ছাপ কেমন করে এলাে? কারা পেরুর নাচকা অঞ্চলের মরুভূমিতে বড় বড় পশুপাখির চিত্র এঁকে রেখেছেন? ইকুয়েডরের মাটির নিচে এতাে লম্বা পাহাড়ি গুহা কারা তৈরি করেছে? কতাে যে রহস্য! আমি কিশাের বয়সে উত্তেজিত হয়ে পড়ি ঐ সমস্ত রােমাঞ্চকর বিবরণ পড়তে পড়তে। কি এক আশ্চর্য উপায়ে আমার চারপাশে পানসে পৃথিবীর রঙ যায় পাল্টে। ফিকে রঙগুলাে যায় মুছে। তার পরিবর্তে আসে ঝলমলে আর টকটকে সব রঙ। দূর পৃথিবীর খবর অনায়াসে চলে আর্সে আমার কাছে। বই-এর খসখসে পাতার ভেতর থেকে নীল সমুদ্রের তরঙ্গ, অজানা মাছের ঝাক, পাখিদের উড়ে আসা আর বাতাসের প্রবাহকে অনুভব করি। কি এক প্রচণ্ড মুগ্ধতার ঘােরে কেটেছে আমার সেইসব উত্তেজনাময় দিন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবিস্মরণীয় চরিত্র খনাদার গল্পে আমি নতুন করে যেন রহস্যের স্পর্শ পেলাম। খনাদার একটি গল্প কি প্রচণ্ডভাবে আলােড়িত করলাে আমাকে! হিমালয়ের সবচাইতে উঁচু মানববসতি | থিয়াংগুচির মঠ, তুষারমানব ইয়েতি, মানস সরােবর, আর এক ধরনের পাখি বুনােহাঁসকে নিয়ে এ রােমাঞ্চকর গল্প। ঐ হাঁসের পেটে রয়েছে এক দুর্গম অঞ্চলের ম্যাপ। গল্পটি পড়ে আমি এতােটাই অভিভূত হয়েছিলাম যে তারপর থেকে যেখানেই ইয়েতির কোন উল্লেখ পেয়েছি তা আগ্রহ করে জমিয়ে রেখেছি। ক্রমে আমার ঝোক চাপলাে পৃথিবীর রহস্যময় ঘটনা এবং স্থানের বিবরণ সংগ্রহ করার। আমার তখন মনে হচ্ছিল, এ সমস্ত বিবরণ পড়ে আমি সহজেই যেনাে ঐ সমস্ত স্থানে চলে যেতে পারি। মনের চোখ মেলে দেখতে পাই সবকিছু। বুঝতে পারছিলাম, আমার মনের চোখ ক্রমশই উন্মােচিত হচ্ছে। দিগন্তের সীমা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাখির নরম পালকের মতাে মন উড়ু উড়ু করতে থাকে। কারা যেনাে কানের কাছে। ফিসফিস করছে রহস্যময় কথা বলে। যেখানেই এ ধরনের কোন কিছুর সন্ধান পাই তুমুল আগ্রহ নিয়ে সেগুলাে জমিয়ে রাখি। ইন্দোনেশিয়ার কমােডাে দ্বীপে কখন দেখা গেছে ভয়ংকর প্রাণী ড্রাগনদের। মালয়ের:ঘাের জঙ্গলে বুনাে মানুষদের দেখা যায়। সাবা সারওয়াকের গহীন অরণ্যে হঠাৎ করে এখনাে দেখা যায় অদ্ভুত আকৃতির কিছু মানুষকে। এভাবেই আমার রহস্যের ঋপিটি ভরে উঠতে থাকে। আজ এ বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে আমি আমার এতােদিনের সঞ্চিত রহস্যের ঝাপিটি খুলে দিয়েছি। যেনাে আবার ফিরে গেছি সেই টুল-বেঞ্চির দিনগুলােতে। সেই নিঝুম দুপুরে। সেই চিলেকোঠার ছাদে। একটি মুগ্ধ কিশাের মুখ বুজে আছে রহস্য-রােমাঞ্চ বই-এর পাতায়। আমি জানি না এখন এই ভিডিও ক্যাসেট শাসিত সময়ে কিশােররা এরকম মুগ্ধ কিংবা আকুল হয়ে রহস্যের খোঁজ করে কিনা ? হয়তাে করে। হয়তাে এখনাে ভাবে পৃথিবীর কোথায় কোন প্রান্তে না জানি রহস্যের স্পর্শ লাগছে। এই বিশ্বাসে এবং উৎসাহে এ বইটি লিখেছি। আলী ইমাম
(জন্ম: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর) আলী ইমামের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। জন্মের ৬ মাস পরই পুরো পরিবারসহ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পুরো পরিবারসহ থাকতেন পুরান ঢাকার ঠাটারীবাজারে।বাংলাদেশী শিশু সাহিত্যিক এবং অডিও ভিজ্যুয়াল ব্যবস্থাপক। আলী ইমাম বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহা-ব্যবস্থাপক ছিলেন এবং ২০০৬ সালে চাকুরী থেকে অবসরগ্রহণ করেন। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ফিচার, ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী সবই তিনি লিখেছেন বাচ্চাদের জন্য