আধুনিক জায়নিজমের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্জেল ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে প্রথম জায়োনিষ্ট সম্মেলনের আহ্বন করে। ক্ষমতাবান, ধনী ও প্রথিতযশা প্রায় দুই শতাধিক ইহুদি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। কীভাবে তাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ‘স্বাধীন ইহুদি’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, তাই ছিলো এই সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয়। এটা সত্য যে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসকগণ তাদেরকে একাধিক প্রান্তে রাষ্ট্র বা বসতি গঠনের নিমিত্তে ভূমি প্রদানে রাজি হয়েছিলো, যেমন : উগান্ডা ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু ইহুদিদের একমাত্র লক্ষ্য কেবলই প্যালেস্টাইন; অন্য কোনো ভূমি নয়। তবে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কখনোই সহজ কাজ নয়। কেননা নতুন ভূমিতে চাইলেই রাতারাতি বসত-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, কাজের সুযোগ, হাঁসপাতাল, বিনোদন-কেন্দ্র, ধর্মীয় সিনেগাগ, ইত্যাদি গড়ে তুলা সম্ভব নয়। তাহলে কীসের আশায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছু বাদ দিয়ে নতুন এই রাষ্ট্রে ফিরে আসবে? আদৌ কী এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? অসংখ্য ইহুদি এই প্রশ্ন তখন হার্জেলের দিকে ছুড়ে মারেন। গরিব ও নিচু শ্রেণীর ইহুদিরা এই ভূমিতে আসতে রাজি হলেও ধনীরা তাদের সম্পদের মায়া ত্যাগ করে কখনোই এই রাষ্ট্রে ফিরে আসবে না। তবে কী এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে না? হার্জেলের উর্বর মস্তিষ্ক এই সম্মেলনের প্রায় এক বছর আগেই The Jewish State শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করে রাখানে। গ্রন্থটি প্রথম ১৮৯৬ সালে জার্মান ভাষায় Der Judenstaat শিরোনামে বের করেন, যেখানে উপরোক্ত প্রতিটি পয়েন্টের বিপরীতে তিনি বিস্তারিত পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। নতুন ইহুদি রাষ্ট্র অবশ্যই প্রতিষ্ঠা পাবে, তবে তা ধাপে ধাপে। প্রথমে এই ভূমিতে আসবে গরিব ও নিচু শ্রেণীর ইহুদিরা। তাদের পরিশ্রমে তৈরী হবে রাষ্ট্রে মৌলিক আবাসন ও বাজার। বিনিময়ে তারা পাবে আহার ও থাকার ভূমি। এরপর আসবে তুলনা মূলক স্বচ্ছল ইহুদিরা। যেহেতু ধনীদের বহু সম্পদ তখনও অন্যান্য ভূমিতে সঞ্চিত থাকবে, সেহেতু তারা চাইলেই এই রাষ্ট্রে আসার পূর্বে তাদের সঞ্চিত ও উপার্জিত সম্পদের একাংশ এখানকার বাজার-বাণিজ্য গঠনে বিনিয়োগ করতে পারবে। সেই বিনিয়োগে তৈরী হবে আরও উন্নত সব ইমারত ও শিল্প কারখানা। তৈরী হবে আরও নতুন কর্মসংস্থান। গড়ে উঠবে সামরিক বাহিনী, যা এই রাষ্ট্রকে অন্য যেকোনো শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। পুরো বিষয় তদারকির জন্য থাকবে দুটি সংগঠন : সোসাইটি অব জিউস এবং দ্যা জুইস কোম্পানী। সোসাইটি অব জিউস রাজনীতি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজগুলো আগে থেকেই সেরে রাখবে, যা বাস্তবায়নে কাজ করবে দ্যা জুইস কোম্পানি। পাশাপাশি অন্যান্য ভূমিতে গড়ে উঠা ইহুদিদের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণ এবং সেই সম্পদ সুষ্ঠ ভাবে নতুন রাষ্ট্রে স্থানান্তরের কাজেও সহযোগিতা করবে দ্যা জুইশ কোম্পানী। এক সময় ধনীরা রাজার হালতেই এই ভূমিতে প্রবেশ করবে। Der Judenstaat গ্রন্থটি পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে, যার ইংরেজি হলো The Jewish State। হার্জেলের এই গ্রন্থটি সেই সময়ে ধনী-গরিব, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সকল শ্রেণীর ইহুদির মানসিকতাকে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলো; বিশেষত জায়োনিষ্টদের। হার্জেল এই কাজের ভবিষ্যৎ দেখে যেতে পারেনি, কেননা ১৯০৪ সালেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু তার জাতির হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষা ‘স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র’ পুনরায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ধনী-গরিব সকল শ্রেণীর ইহুদিতে তা সয়লাব হয়েছে। তার উপস্থাপিত পরিকল্পনার বহু কিছুই পরবর্তী সময়ে এই রাষ্ট্রে অনুসৃত হয়েছে।