ফ্ল্যাপে লিখা কথা জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সেই বর্গের লেখক যাঁদেরকে চিনে নিতে হয়; খেয়াঘাটের মাঝির মতো সহজ পরিচয় মেলে না। তিনিও জলযানের চালক, সাগরের দূরবর্তী অচেনা-অনাবিষ্কৃত দ্বীপযাত্রার মাঝি। সাহসী অনুসন্ধানী যাত্রীর তিনি মাঝি, ওই নতুন অজানা দ্বীপভূমির বটে। ওই দ্বীপ নতুন পলিতে নতুন ভূপ্রকৃতিতে গঠিত। সাহিত্যে তা হচ্ছে তাঁর গল্পভাষা এবং গল্পমানুষ। ঘাটের দশকে যাঁর অভিযাত্রা তাঁকে আধুনিক ছোট গল্পের কবি বলা যাবে না, বলতে হবে বিজ্ঞানী। হ্যাঁ, শব্দ ব্যবহারে, বাক্য বিন্যাসে, জীবন ব্যাখ্যায় যতটা তিনি ভাবুক-কবি, তার বহুগুণ অনুসন্ধানী-আবিষ্কারক বিজ্ঞানী। সেই যে শুরু ‘দুর্বিনীতকাল’ দিয়ে, তারপরদীর্ঘ তাঁর সমুদ্রযাত্রা ওই দূরবর্তী বাংলা ছোটগল্পের দ্বীপে। বাংলাদেশের ছোটগল্পে তিনি কাহিনী শোনাতে নয়, বরং মানব জীবনকে ঘিরে যে জটিল সঙ্কেতময়তা, জীবনের গভীরে প্রতীকী-জীবনের যে বিস্ময় তাকেই চিনিয়ে দিতে চান পাঠককে। গড়পড়তা পাঠকের কাছে তাঁর গল্পের যে দুর্বোধ্যতা তা মোটেই কাব্যিকতার নয়, কেবলই বৈজ্ঞানিকতার। ওই বিজ্ঞানের খেলাটা চলে নতুন নতুন শব্দের আবিষ্কারে যা তাঁর গল্পের শরীরী উপাদান।
তরলায়িত জীবনের তরলায়িত গদ্যে তরলায়িত পাঠকের শিল্পী নন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। জীবনকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে, ব্যক্তিকে অনুসন্ধানের যে প্রযুক্তিগত কৌশল তা বোধ হয় বাংলাদেশের ছোটগল্পে তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেন। প্রকৃতির বর্ণনা আর যাপিত জীবনের বর্ণনা কি করে সাগরের নোনা জলে নদীর অনোনা জল মিশে যাবার মতো একেবারে অভিনতুন জলধারায় পরিণত হয়, তাঁর গল্পের শরীর আর আত্ম তো তা-ই। এমন গ্যেভাষাকেই বুঝি বলা যেতে পারে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নয়, বরং ছোটগল্পের গদ্যমৈলীর মনস্তাত্ত্বিক বিবরণ। এই রীতির আবিষ্কারক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, যে গদ্যরীতি গল্পের চরিত্রের চেয়েও অগ্রগামী। বুঝিবা শব্দ, বাক্য, শব্দের ব্যঞ্জনার্থ তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘটনাকে এবং তার কুশীলবকে। তাই এই সংকলনে স্থান পাওয়া গল্পগুলোর জন্ম তারিখ, বয়স এক নয় এবং এরা কেউ অগ্রজ কেউবা অনুজ। পাঠক এই পার্থক্যটুকু ধরতে পারবেন সতর্কতার সাথে গল্পপাঠ নিলে। দীর্ঘ সময়াধারে লেখকও বদলেছেন, তার গল্পের মানুষেরাও বদলেছে, এমন কি গল্পের ভাষাও। প্রথম দিকের গল্পভাষ্যের যে দর্শনিকতা তা পরবর্তীতে তো বেরিয়ে এসেছে অতি আধুনিক বিশ্বভাবনায়। এ যেনো সেই সমুদ্রযাত্রা যেখানে চলে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে পরিভ্রমণের বদলে আবিষ্কারের নেশায়।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের নিজের গল্পের ভাষা আর আলেখ্য সম্পর্কে আপন জবানি রয়েছে। দেখা যাবে লেখক নিজের লেখার ভেতর নিজেকে যতটা চিনেছেন এবং পাঠকের কাছে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, প্রকৃত অর্থে তিনি তার চেয়েও আলাদা এবং অগ্রগামী। এখানেই বাংলাদেশের ছোটগল্পে বহুভীরের ভেতর একাকী একজন।
সূচিপত্র * পরমাত্মীয় * সাজানো ফুলের বাগান * আরো কয়েকটি পুতুল * একজন পুরুষ চাই * তার ফেরা * গোলাপের নির্বাসন * নাগর বসন্ত * কেষ্ট যাত্রা * রংরাজ ফেরে না * সরল সংসার * পিতৃঘ্ন * ক্রীতদাসী বাসনা * সারাজীবন * আজীবন দিন-রাত্রি * কুক্কুরাধম * পুনরুদ্ধার * বিচার চাই, সম্রাট * অমল তরণী * দিন ফুরানোর খেলা * মন্বন্তর * উড়িয়ে দিয়ে যা কালোমেঘ, বৈশাখের ঝড় * ছায়া দাও * মুকিতযোদ্ধারা * ফিরে যাও জ্যোৎস্নায় * প্রণয় কাহিনী * গ্রাম ও শহর উন্নয়নে গল্প * হিমজীবন * প্লাবনভূমি * রেহাননামা * জলজ কুসুম * জাদুকর জাদু জানে না * জলপরী নাচে * ফুল্ল কুসুম * হিম চন্দ্রাতপে * স্বপ্নে সত্য আছে * লৌহবেষ্টনী
এদেশের সাহিত্যে ষাটের দশক নিয়ে যে-কোনাে বিবেচনার ক্ষেত্রেই অনিবার্যভাবে যাদের নাম উঠে আসবে, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তাঁদের অন্যতম। অন্যতমই শুধু নয়, ব্যতিক্রমীও। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের বিচারেই। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত-র জন্ম ১৯৩৯ সালে কুষ্টিয়ার আমলাবাড়িতে, মাতুলালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ডিপ্লোমাও অর্জন করেন। ১৯৬৯-এ উচ্চশিক্ষার্থে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং সেখানেই গণযােগাযােগে এমএস ও সাংবাদিকতায় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরু ঢাকায়, বাংলা একাডেমিতে। সেখান থেকে যান বাংলাদেশ অবজারভার-এ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও জনসংযােগ/ সম্পাদনার পেশায় কেটেছে দীর্ঘকাল। শেষের আট বছর বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশক জন ওয়াইলি অ্যান্ড সন্স পাবলিশার্স-এ। আটাশ বছর বিদেশবাসের পর দেশে ফিরে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও প্রশিকা'-র তথ্য পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে যােগাযােগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগেও খণ্ডকালীন প্রফেসর ছিলেন, একইসঙ্গে।। বাংলা ছােটগল্পে অবদানের জন্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি সাহিত্যসাধনার প্রথম জীবনেই প্রায় (১৯৭১)। ভাষা ও সাহিত্যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেলেন ২০১৬ সালে ।