শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার মহাপুরুষ। কিন্তু কবিতার বাইরে তিনি প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসও লিখেছেন। একটি উপন্যাস ‘অদ্ভুত আঁধার এক’! পটভূমি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নাদিম ইউসুফ। নাদিম ইউসুফ কবি। ঢাকার সরকারি পত্রিকা দৈনিক পদাতিক-এ চাকরি করেন। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। প্রাণের ভয়ে স্ত্রী নাজমা ও কন্যা নিয়ে জন্মগ্রাম পলাশতলীতে আশ্রয় নেন। শহরের মানুষ নাদিম গ্রামে আশ্রয় নিয়ে দিন যাপন করলে শৈশবের বিচিত্র স্মৃতি ও ঘটনা মনের পর্দায় হানা দেয়। সামনে কবিতা লেখার খাতা। কিন্তু মনের মধ্যে উথাল-পাথাল ঢাকার রক্তাক্ত ভয়ানক পরিস্থিতি। নিজের অসহায়ত্ব অতিক্রম করে চলে যেতে চায় নাদিম যুদ্ধে, দেশের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু পারে না স্ত্রী-সন্তানের মুখ চেয়ে। অন্যদিকে বুকের মধ্যে বাজে আত্মগ্লানির চাবুক। শামসুর রাহমানের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাস মূলত নিজের মানচিত্র। শামসুর রাহমানের গ্রামের নাম পাড়াতলী। উপন্যাসের গ্রামের নাম পলাশতলী! একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে বাঙালির মন ও মানসিকতা পাল্টে গিয়েছিল। উপন্যাসের নায়ক নাদিম ইউসুফের বড় চাচা, সব সময় পবিত্র কোআন পড়েন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আর থাকবো না। যা জুলুম ওরা করতাছে, এই জুলুমের পর পাকিস্তান থাকতে পারে না। অগো উপর আল্লাহর গজব পড়ব।’ ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাসে ছোট ছোট চিত্রকল্প একে শামসুর রাহমান সেই রক্তদিনের বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লেখা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আত্মদহনের উপন্যাস।
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।