ফ্ল্যাপে লিখা কথা প্রকৃতিপুঞ্জ অধ্যুষিত বঙ্গের আরন্যক জীবনের আলো-আঁধারী, ভূমি দেবতা, শস্য দেবতা আর জন্ম-মৃত্যুর দেবতা শাসিত কালের মিথলজিক্যাল হেঁয়ালির গভীর অন্তঃস্রোতে যাত্রা ‘জন্ম জন্মান্তর’ উপন্যাসে।আর্যবৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদের বিলীয়মান ভূমির উপর বর্ণবাদী আর্য্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং প্রাকৃত ধর্মের সঙ্গে সংঘাত শেষে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে চলে সমন্বয়ের কাল । অন্তঃসারশূয়ন্য হিন্দু বর্ণবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র অকস্মাৎ ভেঙ্গে পড়ে তুর্কি আক্রমনে। রাজধর্মের শূন্যস্থান পূর্ণ করে ইসলাম।অন্যপ্রান্তে পরাজিত পলায়নপর হিন্দু সমাজ আত্নরক্ষার নামে সৃষ্টি করে রক্ষণশীলতার শক্ত খোলস। হঠাৎ আলোর ঝলকের মতো নিয়ে যায় ইসলামের সাম্য। রাজশক্তির আনুকুল্য্যে সৃষ্টি হয় আরবিয় আরস্থানীয় রক্ত ধারার নামে মুসলিম বর্ণবাদ। মানবতার মুক্তির গান গেয়ে আসে বাউল বৈষ্ণব মতবাদ। কালচক্রে তাও হয়ে যায় বিলীন। বাণিজ্যিক সভ্যতার নামে আসে ইংরেজ শাসন। সৃষ্টি হয় চূড়ান্ত জাতি বৈরিতা। সংঘাতের মধ্যে ধর্মের নামে খন্ডিত হয় দেশ। আবারো ভাঙনেরর পালা। সৃষ্টি হয় স্বতন্ত্র বাঙালি জাতিসত্তার মহা বিদ্রোহ। আসে বিজয়। মুক্তি ধরা দেয়না অভিশপ্ত ভূমিতে। আর্য্য আর আরবিয় সাম্প্রদায়িক অশ্বের খুরাঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন সমাজ ডুবে যায় অন্ধকারে। একাত্তরের মহাবিদ্রোহের ভূমি প্রবেশ করে তমস যুগে পুনর্বার । এই অভিশপ্ত ভূ-ভাগকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বৎসরের জন্ম জন্মান্তরের মহাচক্রে এক প্রাকৃতজন কথানো নবরূপে ,কখনো ইতরপ্রাণী এবং প্রেতরুপে আবর্তিত হয়ে থাকে। দূরাগত বিধর্মী শক্তির ভয়ে আদিম পুরুষ জন্মভূমি আর শস্যক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে যেয়ে শস্যদেবী কর্তৃক হয় অলঙ্ঘনীয় অভীশাপে শৃঙ্খলিত। অর্জুনের অশ্ব, রামচন্দ্রের অশ্ব, তুর্কি বখতিয়ারের অশ্ব, সিরাজ-উ-দৌলার অশ্ব আর রবার্ট ক্লাইভের অশ্বেরা লণ্ডভণ্ড করে দেয় তার যুগ যুগান্তরের স্বপ্ন। আর্য্য পুরুষের তরবারিতে খন্ডিত হয় তার মস্তক ,তুর্কি শক্তির ভয়ে পালাতে গিয়ে হারিয়ে যায় গহীন নদীর অতলে,শেষ বর্ণনীলকর সাহেবের অশ্বখুরাঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয় তার দেহ। ঈশ্বরের নির্বাচিত জন্মভূমি পরিক্যাগ করে অভিশপ্ত মানুষটি সীমান্তের ওপারে চিরস্থায়ী চিরশান্তিময় ঠিকানার সন্ধানে হেঁটে যায়। ফিরে আসতেই হয় তাকে।তবু ফেরা হয় না। অপমৃত্যু হয় সীমান্তে। ধর্ম-ধর্মান্তের ঘোর অন্ধকারে ঠিকানাহীন শেকড় ছিন্ন মানুষটির মৃতদেহ অস্বীকৃত হয় মর্ত্যলোকে। উর্ধবলোকে ঈশ্বরের মহাবিচার সভায় তার বিদেহী আত্নার শেষ যাচনা-স্বর্গলোক নয়, মাটির পৃথিবী। দৃশ্যমান জগৎ , অদৃশ্য মৃতদের জগৎ আর মিথের জগতের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে উপন্যাসটির প্রাচীন আবহ। উপন্যাস শিল্পের প্রথাসিদ্ধ রীতি ভেঙে গেছে এখানে। হাজার বছর বয়সী মানুষটির জন্ম আর মৃত্যুর পৌন:পুনিকতা হচ্ছে একটি অখন্ড মানবসত্তার অসংখ্য ভাঙনের প্রতীক। জন্মন্তরবাদ এখানে সুবিস্তীর্ন ধাবমান সময় মাত্র। দেব-দেবীরা হচ্ছে কৃষি ভিত্তি লোকজ সমাজের বিশ্বাস আর কামনা-বাসনার অবয়ব। মানুষের আদিম ঠিকানা শস্যভূমির প্রতি মমত্ব এবং অন্তহীন কালের জন্য মাটির অচ্ছেদ্য বন্ধনের তীব্র ব্যাকুলতার প্রকাশ হচ্ছে স্বর্গলোকের প্রতি নিরাসক্তি।
হরিপদ দত্ত। জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৪৭ খ্রি. গ্রাম : খানেপুর, উপজেলা : পলাশ, জেলা : নরসিংদী। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: অজগর, জন্মজন্মান্তর, দ্রাবিড় গ্রাম, মোহাজের, চিম্বুক পাহাড়ের জাতক (৪ খণ্ড) প্রভৃতি। গল্প সমগ্র, প্রবন্ধ সমগ্র ও শিশু-কিশোর সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। পুরস্কার : বাংলা একাডেমি পরিচালিত সাদ’ত আলী আকন্দ সাহিত্য পুরস্কার ২০০১ এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬ (উপন্যাস)।