লোকান্তরে নিয়ে যাওয়ার বাসনা অনেক কবিরই কন্ঠে নি:সৃত হয়। জীবনের পরপারে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ অনেক কবিরই কাম্য। কিন্তু পার্থক্য দেখা যায় তাল লয়ে। স্বরগ্রামের ভিন্নতায় এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেও। কেউ বলেন 'মৃত্যু কেবল মৃত্যুই ধ্রুবসখা/যাতনা শুধু যাতনাই, সুচিরসাথী'। বেদনাক্লিষ্ট আত্মজর্জরিত সুর। সুধীন্দ্রনাথে কাজ করেছে 'ফাটা ডিমে তা দিয়ে আর কি ফল পাবে?' এর মত হতাশাবোধ আর 'অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?' এর মত ভয়বোধ। এতে উত্তপ্ত ঘৃণা তেমন নেই। না নিজের প্রতি না পরিবেশের প্রতি। কন্ঠে বোদলেয়ারীয় আভাস নেই জীবন সম্পর্কে। বোদলেয়ার মৃত্যুকে ডাকেন অন্য সুরে 'This country bores, death! Let us set sail' (The Voyage)। বন্ধুর মত আত্মীয়তাবোধ। কারন তার কাছে পৃথিবী 'An oasis of horror in a desert of ennui'। তিনি মানুষের মধ্যে যে দুটি প্রবল দাবী অনুভব করেছেন তার কোনটিই পৃথিবীর প্রতি নয়। তার মতে 'প্রতি মানুষের মধ্যে, প্রতি মুহুর্তে দুই যুগপৎ দাবি রয়েছে, একটি ইশ্বরের প্রতি আর একটি শয়তানের প্রতি'। তিনি যে জীবনের অধিবাসী যে মস্তিষ্ক তার জীবন পদ্ধতি পরিচালনা করছেন তা 'যেন গহ্বর এক পিরামিড, বিরাট জঠরে/যত শব ধরে, তত গোরস্তানেও কখনো পড়ে না। আমি এক আঁধার কবরখানা চাঁদের অচেনা' (লা ফ্ল্যর দ্য মাল ১৮৫৭, বুদ্ধদেব বসু অনুদিত)। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় পৃথিবী বিমুখিতার শত নির্যাস থাকা সত্ত্বেও ধ্বনিত হয় 'নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাস্ময় জগৎ/নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জলন্ত হৃদয়' (সৃষ্টি রহস্য, ক্রন্দসী)। আবদুল মান্নান সৈয়দ সুধীন্দ্রনাথে যথার্থই অনুভব করেছেন 'কালো সুর্যের নিচে বহ্নুৎসব?'। তারই অনুরূপ সুর অনুরণিত হতে দেখি আমাদের বাংলাদেশী কবিরও কন্ঠে 'মনে হয় সব ঈর্ষা ভালোবাসা হবে/হৃদয় সম্রাট হবে পৃথিবীর' (তারা দুজন, আহসান হাবীব)। লোর্কা, রেঁবো এরাও মৃত্যুর দিকে হাত বাড়িয়েছেন। কবিতার প্রশস্ত হাত। লোর্কা গোলাপ বাগানের চাপ চাপ অন্ধকারে ছোপ ছোপ রক্ত দিয়ে মৃত্যুর সাথে সখ্যতা পাততে চেয়েছিলেন। এবং আততায়ীর হাতে ছোপ ছোপ রক্ত দিয়ে মৃত্যুর সাথে সখ্যতা অবশ্য তিনি পেতেছিলেন, কিন্তু গোলাপ বাগানে কিনা তা আর আমাদের জানা হয়নি। গর্ভবতী 'দুয়েন্দে'র সাথে তার যে চির আকাঙ্খিত অভিসার তা যে গোলাপ বাগানেই হবে তা যেন তিনি ধরেই নিয়েছিলেন সন্দেহাতীত ভাবে। অন্ধকারকে, কালোকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। সমস্ত নিকষ অন্ধকারে দেখেছেন তার 'দুয়েন্দে'। তিনি মৃত্যুর সবকটি সন্তানকেই বুকের মধ্যে পুষে পুষে বড় করেছেন। জীবনের গহীন আকাশে দেখেছেন মৃত্যুর জ্যোতির্ময় গোলাপ। মোহিতলালেও এরকম মৃত্যু রোমান্ঠিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মোহিতলাল ও মৃত্যুর দিকে চেয়ে থাকেন আর লেখেন 'আমি চেয়ে থাকি অনিমেখ-আঁখি মরণ শয়নাগারে' (দ্বীপ শিখা) এবং 'মরণের ফুল বড় হয়ে ফোটে জীবনের উদ্যানে' (মৃত্যুশোক)। যথেষ্ট উদার ছিলেন তিনি মৃত্যুর প্রতি। যে মালার্মে মৃত্যুকে দেখেছিলেন এক অতল গহ্বর হিসেবে তাকে মোহিতলাল কিভাবে দেখছেন একটি সুন্দর ফুল হিসেবে জীবনের উদ্যানে! একি শুধু বাগ্মিতা? এ কোন আশ্বাস, কোন দৃঢ় বিশ্বাস মোহিতলালকে এত সন্জীবিনী সুরায় উজ্জীবিত করেছেন? একি অতিলৌকিক কোন বিশ্বাস নাকি জীবনেরই কোন গভীর অতলান্তে গুঁজে রাখা আনন্দ শিখর? নাকি আহসান হাবীবের মত 'মৃগনাভী ছলনায় নিজেকে নিজে মগ্ন করে রেখেছেন' (হে বৈশাখ)। অল্প পরে এ কবির কন্ঠে আরো গভীর এক অহংবোধ জাগে কিছুটা বিনম্র স্বরে 'তুমি কিছু রসে রোদে/আমাকে বাঁচিয়ে রেখো/সেতো তোমারই গরজ প্রভু' (হে বৈশাখ)। কিন্তু সবচেয়ে নিপুণ দ্বৈত সত্তার কবি, যিনি মৃত্যু ও জীবনেরে সমান শান্তভাবে অভিবাদন জানিয়েছেন তিনি পর্যন্ত এক ক্ষণে জড় প্রকৃতির প্রতি নিদারুণ ক্ষোভে প্রশ্ন করেছিলেন 'মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে/সরল জীবনে'। তিনিও বিশ্বের ভৈরবী চক্রে বিধাতার প্রচন্ড মত্ততা দেখে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। ক্ষুদ্ধ হয়েছেন দেহের মৃৎভান্ড ভরে রক্তবর্ণ প্রলাপের অশ্রুস্রোত দেখে। তথাপি তিনি আপন আলোকে ধৌত। তিনি মৃতু্কে ডেকেছেন 'এসো শান্তি এসো সুপ্তি বলে। রেঁবোর সমুদ্র যন্ত্রণা আবার অন্যরকম। এ যেন বোদলেয়ারীয় পরিমণ্ডলে বিচরণরত আর এক স্তেফান মালার্মে। কন্ঠেও একি ঘৃণা একই বিষবাস্প। পৃথিবী সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে। 'নীলিমা নিবদ্ধ চোখে অধরার নিশ্চিত ঠিকানা/পাশব উদ্গার নাকে, মর্ত্যলোক দুর্গন্ধে অশুচি' (বাতায়ন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনুদিত)। পুতিগন্ধময় এই জগৎ। নিরাশায় জান্তব। জৈবিক ক্ষুধায় পাশবিক উল্লাসে নৃত্যপর। শকুনীদের আনাগোনা চরাচরব্যাপী। আশ্চর্য সুনীল আকাশ জুড়ে ঝুলে আছে মরা বাদুড়ের দল। অসুস্থ বসন্তে ঘুম ভাঙে জৃঙ্গনে। অসন্তাপ আর নিখিল নাস্তি আদিগন্ত বিস্তৃত। সেখানে স্তেফান মালার্মে পরাজিত - 'আর আমি পরাজিত, প্রেতভয়ে পান্ডু, দ্রুত-পদ/ঘুমাতে পারি না একা, ভাবি শয্যা শবের প্রচ্ছদ' (উৎকন্ঠা, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনুদিত)। এই হতশ্রী-বিতশ্রী দু:খময়ী শবশয্যার পৃথিবীতে তিনি সত্যিকার অর্থে সৌন্দর্যের অভিলাসী ছিলেন। যাত্রা ও ছিল তার সৌন্দর্য অভিপ্রায়ে। যাত্রা পথে ভগবানের সাথে কুস্তিও ধরলেন এবং ভগবানকে কুপোকাৎও করলেন। কিন্তু ভাগ্য বিপরীত। সৌন্দর্যের মাঝে বিষাক্ত কীট কিলবিল করছে। একি নৈর্ব্যক্তিক পাপের অক্টোপাসি আলিঙ্গন? না হয় নীলিমার মাঝে থেকেও স্তেফান মালার্মে আর্তচিৎকারে কেঁপে কেঁপে উঠেন যেন বার বার - 'কোথায় পালিয়ে বাঁচি। বিদ্রোহ কি সর্বত্র বাতিক/নীলিমা নিমগ্ন আমি; চতুর্দিকে নীলিমা, নীলিমা' (নীলিমা, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনুদিত)। এ বিদ্রোহ এ অসুন্দরবাস কি নীলিমার না মালার্মের নিজস্ব বাতিক! নয়তো যে এত সুন্দর পিয়াসী, যিনি এই সুন্দরের জন্যে ভগবানের সাথে কুস্তি ধরতেও দ্বিধাবোধ করেন না, তিনি কেন সবসময় দেখতে পান সামনে এক কালো গহ্বর? অতল অসীম অন্ধকার! যে অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে ন্যায়বোধ আর তার সাথে সকল নীলিমা। নীলিমা নিবদ্ধ আর্তচিৎকার চারদিকে। প্রতীচ্যের কবির এই মর্মভেদী আর্তনাদ আমাদের বাঙালী কবির ঘরেও উঠেছে। 'এ বিষন্ন বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পঙক্তিও হব না/হে নীলিমা, হে অবগুন্ঠন/ লোকালয় থেকে দুরে, ধোঁয়া অগ্নিমসলার গন্ধ থেকে দুরে/ এই দলকলসের ঝোঁপে আমার কাফন পড়ে আমি কতকাল/ কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিষাদ?' (কালের কলস, আল মাহমুদ)। জীবনানন্দেও দেখি সেই 'Land of Dreams' অনেক দুরে সরে পড়েছে। সন্দেহ যেন বিশ্বাসে পরিণত হয় হয় ভাব। অন্য এক 'না' বোধক বিশ্বাস মাথাছাড়া দিয়ে উঠছে। 'যে জীবন ফড়িং-এর দোয়েলের মানুষের সাথে হয় নাকো তার দেখা'। বুঝে নিয়েছে যেন কবি জীবনমুখী রোমান্ঠিকতার ফাঁকি পুরোপুরি এবং বুঝে নিতে পেরেছে বলেই সাদরে তাকে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ জাগে নি। তাই কোন কুয়াশা হতাশা-বোধ তার করালগ্রাসে কবিকে আচ্ছাদিত করতে পারে নি। কুয়াশা হতাশা নিয়ে সরে তিনি যান নি পৃথিবী থেকে (রোমান্ঠিকতার আদিরূপ প্রেম এবং বিষাদ। নারীপ্রেম, জনপ্রেম, ইশ্বরপ্রেম, প্রভৃতির মাঝে এর শিকড়। অবশ্য অধিকাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে প্রেমের প্রথমানুভুতি নারীপ্রেমেই প্রথম উপলদ্ধ হয়। T S Elliot যে Eternity কে ধরে রাখার সাহস অনুভব করেন তাও প্রেমিকাকে দেয়া একটি প্রগাঢ় চুম্বনের বদৌলতে। রূমী ইশ্বরকে দেখেন সুন্দরী রমণীর মধ্যে)। জীবনানন্দের ঘরে এই সুন্দর প্রেমের অভিসার মুহুর্তে কবি হঠাৎ চমকে উঠেন জ্যোৎস্নায় কালো ভুত দেখে। এ কবিও মৃত্যুর সান্নিধ্য পাওয়ার অপেক্ষায় ঘুরেছেন পেঁচার চোখে চোখ রেখে কুয়াশার আস্তরনে আস্তরনে। নিবিড় সখ্যতায় শুয়ে থেকেছেন নরম সবুজ ঘাসে। পউষের খড়ে। কাঁঠাল পাতায় শিশির পতনের শব্দটুকু পর্যন্ত শুনেছেন। তথাপি তিনি কাদাল পৃথিবীতে ধবল চাঁদের ভীষণ কোন পতন দেখেন নি, দেখেন নি কোন কুটিল পাপের শৃংগার রস।