ভাষা আন্দোলনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তাঁদের আত্মপরিচয় নিয়ে খুব একটা ভাবেনি অথবা ভাবার অবকাশ পায়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত আমাদের সাহিত্য ছিল পাকিস্তান ভাবধারায় প্রভাবিত। তখন বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য হারাতে থাকে নিজস্বতা। সাহিত্যে জুড়ে বসে সাম্প্রদায়িক চেতনা। এজন্য এসময়কার সাহিত্য ছিলো প্রগতিবিমুখ, অনাধুনিক এবং অনুর্বর। গবেষকরা বলেছেন এ সময়টা হলো বাংলা ভাষার সাহিত্যিক-শৈল্পিক বন্ধ্যাত্ব। ভাষা আন্দোলন এই বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তির উজ্জ্বল সিঁড়ি। এ আন্দোলন আমাদের দিয়েছে স্বকীয়তা, আত্মপরিচিতি স্বত্ত্বা ও প্রকৃত সাহিত্য চেতনা। আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে— মাতৃভাষার ওপর পাকিস্তান শাসকের এই আঘাতের মূল উদ্দেশ্য কী। এটি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রাদেশিক হিসেবে রাখা, জাতীয় পরিচয় মুছে ফেলা, আমাদের পরাধীনতাকে স্থায়ী করার একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা। ভাষা আন্দোলন ধীরে-সুস্থে কৌশলে প্রতিবাদী করেছে আমাদের কবিদের ছড়ালেখকদের। স্বাধীন পরিবেশের অভাবে এই প্রতিবাদের ভাষা মনের মতো প্রস্ফুটিত হতে পারেনি। ১৯৪৮ থেকে নীরবে ভাষা আন্দোলন শুরু হলেও বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে কবি সাহিত্যিকদের প্রতিবাদও বিস্ফোরিত হয়। জন্ম হয় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর একুশের প্রথম কবিতা "আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি”। সেই থেকে শুরু একুশের ছড়া-কবিতা রচনা, যা এখনও অব্যাহত। হবে না কোনদিন। আজ একুশ নিয়ে লেখা যেন আমাদের লেখকদের আরাধনা। ১৯৫২ থেকে আজ অবধি একুশকে নিয়ে যত ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে তাতে যেমন ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে তেমনি এ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবনা চিন্তাও প্রতিফলিত হয়েছে। একুশ আমাদের যে ধারায় জাগ্রত করেছে সেই ধারায় এসেছে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, সত্তর-এর নির্বাচন, একাত্তর-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধ যুক্তির দিক থেকে, বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে, প্রস্তুতির দিক থেকে, চেতনার দিক থেকে এবং আবেগের দিক থেকে একুশেরই প্রতিশ্রুতি। একুশে অন্তর্নিহিত আছে মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, শহীদ স্মৃতিবাহী শহীদ মিনার, বর্ণমালা, ফাগুনের রক্তিম রূপ, কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বলতা- আরো অনেক বিষয়। আমাদের প্রায় প্রত্যেক কবি-ছড়াকার একুশ মিশ্রিত বিষয় নিয়ে লিখেছেন ছড়া-কবিতা। একুশের ঘটনার পূর্বেও মাতৃভাষার আবেগ ঢেলে অনেক খ্যাতিমান কবি কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন গান। আমাদের মাতৃভাষা-বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলনের আগেও যেসব কবিতা, ছড়া, গান লেখা হয়েছে সেগুলোও মাতৃভাষা চেতনাকে স্বচ্ছতা দিয়েছে। করেছে সতেজ সজীব প্রাণবন্ত। করেছে বেগবান। বাংলা স্বদেশী গানে অতুল প্রসাদ সেন বলেছেন : মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা ! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কত শাস্তি ভালোবাসা!!
নাসের মাহমুদ ছড়া লিখছেন সত্তর-দশক থেকে। শুরু থেকেই বৈচিত্রের স্বাদ যুগিয়েছে তাঁর ছড়া । ছড়ার কুশলী কারিগর তিনি। ছড়া গড়েন, পড়েনও। ছন্দের আধুনিকতায় আর অন্তমিলের নতুনত্বে তাঁর দক্ষতা ঈর্ষণীয়। জীবনের সিংহভাগ সময় তাঁর কেটেছে কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত মুখ নাসের মাহমুদ। সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোটের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা। একজন ভালাে সংগঠক হিসেবেও তিনি সফল। জন্ম : ১৯৫৬ সালের ১ জুলাই রাওয়ালপিন্ডি। পৈত্রিক বাড়ি রাজবাড়ি জেলার পাংশায়। ভাতশালা গ্রামে। প্রথমে নিজ গ্রাম, পরে নানাবাড়ি চাঁদপুরের মতলব -এ (ধনাগােদা তালতলী)। তারপর ঢাকায় লেখাপড়া করেছেন। ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি করেছেন বিভিন্ন জেলায়। ঢাকার সাপ্তাহিক ‘মানবতা'র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৮৩-তে। ব্যবসা ও ভ্রমণসূত্রে গিয়েছেন হংকং, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ম্যাকাও, ভারত ও নেপাল। বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসা করছেন। গল্প, কবিতা ও ছড়া লিখছেন প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। পিতা-মরহুম শাহ লুঙ্কর রহমান বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ও কশবা মাজাইল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিও কবিতা লিখতেন। নাসের মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ “যে তুমি একমাত্র আমার’ ১৯৮৭। ছড়ার বই ‘খুলে খাপটা সােজা সাপটা’২০০৫।