ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তী পেশায় সরকারি কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। সাহিত্যপাঠ এবং সাহিত্য পড়ানো তাঁর পেশাগত কাজের নিত্যদিনের অংশ। কিন্তু মননশীলতার জন্য শুধু সেটাই যথেষ্ট নয়। মননশীলতার অঘোষিত ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনালোকিত শর্তটি হচ্ছে সৃজনশীলতা। যার মাঝে সৃজনশীলতার আবেগ ও সংবেদনশীলতা থাকে, মননশীলতার চর্চায় আত্মনিয়োগ করলে তার সাফল্য লাভের সম্ভাবনা তত বেশি হয়। একজন সাহিত্য সমালোচককে অন্যদের সৃজনশীল কাজের বা সৃষ্টির মূল্যায়ন করতে হয়। সেকাজ হচ্ছে কবিতা, কথাশিল্প, গান বা নাটক। আর মূল্যায়ন মানে যেমন সৃজনশীল শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের বক্তব্য বিষয়ের মর্মোদ্ধার তেমনি সেসবের শৈল্পিক ঐশ্বর্যের তুলনামূলক অবস্থান নির্ধারণ। মননশীলতার সবচেয়ে বড়ো দুটি শর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত তুলনামূলক জ্ঞানের অধিকার এবং বিচারিক বস্তুনিষ্ঠতা। মূল্যায়নাধীন সাহিত্যিক সম্পর্কে পূর্বে থেকে অর্জিত অন্ধভক্তি কিংবা গভীর বিদ্বেষ সাহিত্যসমালোচনার পথে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায়। সাহিত্যসমালোচক নিজেও একজন রক্তমাংসের মানুষ বলে তারও আবেগ থাকে, সংবেদনশীলতা থাকে, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থাকে। তবে কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের সময় যতখানি সম্ভব সেই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ একপাশে সরিয়ে রেখে কাজ করতে হয়। মানুষ হিসেবে বাঙালিরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ এবং হাজারো রকম বিভাজনে বিভক্ত বলে মননশীলতার ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বাংলাসাহিত্যের ভুবনে কবি-কথাশিল্পী-সংগীতকারের তুলনায় প্রাবন্ধিক ও সমালোচকের সংখ্যা অনেক কম এবং এই দীর্ঘসময়ে যে-অল্পসংখ্যক প্রাবন্ধিক-সমালোচকের আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের বেশিরভাগের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ মনের ঘাটতি লক্ষণীয়। আশার কথা যে, মুক্ত মিডিয়ার প্রাধান্যের ফলে বর্তমান সময় পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিযোগিতা নিয়ে আসায় এবং সবকিছ অন্তত মিডিয়ায় অনেক বেশি উন্মুক্ত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ফলে সেব্যাপারে সাহিত্যসমালোচকদের অনেকেই সক্রিয়ভাবে সচেতন হয়ে মননশীলতার চর্চার দিকে মনোনিবেশ করছেন। ড. ফাল্গুনী রানী চক্রবর্তীও ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি পাঠের সময় বিষয়গুলো আমার মনে এসেছে নতুন করে।