কবি হাশিম কিয়ামের কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে মানে মুগ্ধ করার মতো জাদু আছে। জীবন সুখ—দুঃখের অবিমিশ্র দ্রবণ হলেও দুঃখের পাল্লাটাই ভারি। সেখানে সুখ ক্ষণস্থায়ী, দুঃখ দীর্ঘস্থায়ী। ‘একগুচ্ছ সরল রেখা’ হাশিমের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ পাঠে এমনই উপলব্ধি আমার। ‘ইট কি ভুলে যায় মাটির গান যতোই পোড়াও ভাটার/ আগুনে’! (মাটির গান)। হাশিমের ভেতর জটিল এক দ্রোহের বাস। সে দ্রোহ শুধু একালের নয়, লক্ষ বছরের দ্রোহের স্রে্রাতধারার পরিণত শিল্পিত রূপ। সেখানে ‘লাশের পাহাড় চাপায় মৃত্যুও কেঁদে ওঠে’ (জলপাইরঙা উপত্যকা)। শঠতা—বঞ্চনার কষ্ট কাল থেকে কালান্তরে প্রবাহিত। তাঁর যে কষ্ট বা হতাশা তা শুধু তাঁর একার নয়, বা এই সময়ের নয়; তা সর্বকালের, সর্বদেশের, সর্বজনের। ‘রক্তভেজা/ মাটির বুকে পুঁতে রাখা ঘুমপাড়ানি গান, বুনো নখের/ ছোবলে মাংসের পচন, গলা কাটা ইতিহাসের/ নিস্তেজ শরীর আমাকে তাড়া করে’ (পলানটুক)। হাশিমের কবিতা শুধু আবেগ দিয়ে নয়, মেধা দিয়ে পড়তে হয়। তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, মূলত দুর্বোধ্য নয়, ভাবের গভীরতায় নিমগ্ন। ফল্গুধারার মতো উপরে শুকনো বালি, নিচে টলটলে জল। অনেক গভীর খেঁাড়াখঁুড়ি শেষে পাওয়া যায় তাঁর ভাবের রহস্য। ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হেরে যেতে/ যে ভয় পায়, তার বাসর সাজানোর শখ/ বাদুড় ওড়া গুহার/ দেয়ালে অঁাকা বুনো ষাঁড়ের শিঙ থেকে ফিনকি/ দিয়ে ঝরে’... (গুহাচিত্রের ফসিল)। কিংবা, ‘শিকারোৎসব/ গুহাচিত্রের গলা ধরে অপেক্ষার রোদ পোহাচ্ছে’ (গর্ভফুল)। এরকম অজস্র্র পঙ্ক্তি পাঠককে নিয়ে যায় গহিন কোনো অমৃতলোকে। মিথের ব্যবহার কবিতাকে ঋদ্ধ করে। মিথের প্রতি হাশিমের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। অজস্র্র মিথের ব্যবহার হাশিমের কবিতাকে ভারাক্রান্ত করে নি কোথাও, বরং কবিতাকে করেছে ব্যঞ্জনাবহ এবং ঋদ্ধ। পাঠককে নিয়ে যায় কল্পনার দেশ—কালের অতীতে। ‘কঙ্কাবতীর সাথে ঘুমাবো বলে/ কালো জাদুর তরবারি দিয়ে শৈশব/ হত্যা করে তার লাশের মগজে জেগে আছি’... (ঘুমের বালুভরতি চোখ)। ‘মিসাইলের পিঠে চড়ে/ ডেলফির ওরাকল আছড়ে পড়ছে শিশুর দোলনায়; বৃন্দাবনের বাঁশির সুর/ আটকে গেছে কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা জীবনের প্রচ্ছদে’... (প্রচ্ছদ)। উপমা প্রয়োগে কবি সিদ্ধহস্ত। উপমা ব্যবহারের চমৎকারিত্বে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে অসামান্য। নতুন নতুন উপমা তাঁর কবিতাকে ভিন্ন আলোয় উপস্থাপন করে। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই রূপকাশ্রয়ী। ইঙ্গিত তার প্রধান বাহক। সহজাত উচ্চারণ কিন্তু শেকড় অনেক গভীরে। তবে সুখপাঠ্যও। ‘মৃত্যু প্রাচীন নর্তকী... থামায় না তার উদ্দাম নাচ’... (দগ্ধ ভ্রমণ)। কিংবা, ‘গুহামুখ থেকে সূর্য গুটিয়ে নিয়েছিলো/ চিকন ডানা’ (গর্ভফুল)। কিংবা, ‘আমাদের গল্পগুলো ঝিনুকের বুকে মুক্তা’ (নদীর বুকে সাগর)। হাশিমের কবিতা পাঠের শেষে একটা রেশ থেকে যায় ভাবনার। পাঠককে ভাবায়। পাঠককে নিয়ে যায় ভাবনার অন্য এক নতুন জগতে। ‘যেমন করে জলের ফেঁাটার ভেতরে বৃষ্টির/ হাহাকার ভেসে বেড়ায়’ (শূন্য)। কিংবা, ‘চিত্রের মাঝে অদৃশ্য চিত্র হয়ে রয়ে যাবো গুহার দেয়ালে’... (গর্ভফুল)। কিংবা, ‘কাঁটাতারের বেড়ায় ভাগ হয়ে যাবে/ খোলা আকাশের স্বাধীনতা ... ... ... সোনার খাঁচা ভেঙে/ আমিও উড়ে যাবো তোমার উড়াল/ রেখা ধরে’ (উড়াল)। পাঠের আনন্দ নিয়ে মানুষ একদিন পড়বে হাশিমের কবিতা। তাঁকে আবিষ্কার করবে। তাঁর কবিতার ভেতর চিনবে নিজেকেÑ ‘মানুষ কি সত্যিই চিনতে পারে/ স্বপ্নের ছায়ায় মোড়া নিজেকে’ (স্বপ্নের ছায়ায় মোড়া মানুষ)। জয়তু কবি হাশিম কিয়াম। জয় হোক কবিতার, জয় হোক মানবতার। সন্তোষ ঢালী কবি ও কথাসাহিত্যিক
হাশিম কিয়ামের জন্ম ২০ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে, চুয়াডাঙ্গাল জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ডাউকি গ্রামে। তার বাবার নাম মোঃ কিয়ামদ্দিন মণ্ডল, মায়ের নাম মোছাঃ রোমেছা বেগম। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত আছেন।