আমাদের অনূদিত বইটির বৈশিষ্ট্য: ১. মূল আরবি গ্রন্থ ও ইংরেজি-উর্দু অনুবাদের সমন্বয়ে গ্রন্থটির বাংলা (সুন্নাহ ও প্রাচ্যবাদ) অনুবাদ করা হয়েছে। ২. আমাদের অনূদিত গ্রন্থটির শুরুতে সংযুক্ত করা হয়েছে আল্লামা ইউসুফ বানুরি রাহিমাহুল্লাহ-এর পর্যালোচনামূলক নাতিদীর্ঘ ভূমিকা, যা তিনি উর্দু অনুবাদের ভূমিকায় লিখেছিলেন। এছাড়া উর্দু অনুবাদ সম্পাদনায় মাওলানা ইদ্রিস মিরাঠি রাহিমাহুল্লাহ-এর জ্ঞানগর্ভ টীকা ও সংযুক্তিসমূহও যুক্ত করা হয়েছে ‘সুন্নাহ ও প্রচ্যবাদ’ গ্রন্থের টীকাতে। ৩. সকল উদ্ধৃত তথ্য রেফারেন্স যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। ৪. প্রচুর রেফারেন্স যুক্ত করা হয়েছে এবং রেফারেন্সবিহীন প্রায় সকল উদ্ধৃতিগুলোর রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে। ৫. লেখকের উদ্ধৃতিসমূহে মাখতুত (হস্তলিপি)-র উদ্ধৃতির পরিবর্তে বর্তমানে গ্রন্থের বিদ্যমান মুদ্রিত ভার্সন থেকে আপডেট তথ্যনির্দেশ যুক্ত করা হয়েছে। ৬. লেখকের ভাষা স্পষ্ট করা ও তথ্য যুক্তি শানিত করা হয়েছে। লেখকের অস্পষ্ট বাক্যগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে। ৭. লেখকের তথ্যগত প্রমোদ ঠিক করা হয়েছে। যেমন, ক. ইলমি পরিভাষা উপস্থাপনে লেখক রহ.-এর তাসামূহ (ত্রুটিসমূহ) ঠিক করা হয়েছে। খ. লেখকের যেসকল যুক্তি ও উপস্থাপনা অপরাপর যুক্তির ধোপে টেকে না সেসব যুক্তি ও উপস্থাপনাকে আরও শানিত করা হয়েছে। ৮. মূল আরবি বইটি যেহেতু লেখকের পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ, তাই পরবর্তিতে সামান্য পরিমার্জন করে গ্রন্থে রূপায়ন করলেও মূল আরবি গ্রন্থটি পরিপূর্ণ সুবিন্যস্ত গ্রন্থরূপ পায়নি৷ অপরদিকে আরবি থেকে উর্দু অনুবাদক ড. মাওলানা আহমাদ হাসান টুংকি রহ., ড. মুসতফা আস-সিবাঈ রহ.-এর পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভকে একটি চমৎকার বিন্যাস ও শিরোনাম সহকারে উল্লেখ করে পরিপূর্ণ গ্রন্থ পাঠের স্বাদ দিতে সক্ষম হয়েছেন। যে কারণে আমরা বিন্যাসের ক্ষেত্রে উর্দু অনুবাদ থেকে সাহায্য নিয়েছি। ৯. উর্দু-ইংরেজি অনুবাদ থেকে সমসাময়িক ও প্রয়োজনীয় কিছু টীকা ও ইংরেজি নামসমূহের সঠিক উচ্চারণ ও ঈসাব্দ তারিখ নির্ণয় সহ আরও বেশ কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ১০. মূল আরবি বইটি পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ হলেও মূল-লেখায় তেমন টীকা এবং রেফারেন্স ছিলো না। কিন্তু গ্রন্থাকারে রূপায়নের ফলে প্রয়োজনটি দেখা দেয়। এজন্য আমরা লেখকের উৎসগ্রন্থের আলোকে প্রচুর রেফারেন্স যুক্ত করেছি। পাশাপাশি সকল হাদিসের তাহকিক ও তাখরিজ সংযোজন করেছি, যা অনুবাদটিকে একটি স্বতন্ত্রতা দেবে বলে আশা করি। ১১. বইটি যেহেতু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেসাবভুক্ত, সে বিষয়ে খেয়াল রেখে হাদিসের অনুসন্ধানী পাঠকের জন্য প্রয়োজনীয় এবং উপকারী প্রচুর টীকা ও পর্যালোচনা যুক্ত করা হয়েছে। ফলে অনুবাদটি আরো স্বাতন্ত্র্য ও পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আশা করি ইনশা আল্লাহ।
ড. মুসতফা সিবায়ী রহিমাহুল্লাহ— ইলমি অঙ্গনে এক সুবিদিত নাম। কুরআন-সুন্নাহ-সিরাত এবং ইতিহাসের মিশেলে তৈরি করতেন তার অনবদ্য সব প্রবন্ধ-গবেষণা পত্র এবং গ্রন্থ। তার প্রতিটি রচনায় উপচে পড়তো উম্মাহর প্রতি দরদভরা জাগরণী সুর এবং মিথ্যাপন্থি যারা, বিশেষ করে প্রাচ্যবাদী, তাদের বিরুদ্ধে তার বয়ান-বক্তৃতা-রচনাসম্ভার যেন ছিলো কোনো অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি, যার তেজোদ্দীপ্ত লাভার উত্তাপে ছারখার-প্রায় হয়ে পড়তো মিথ্যার সমস্ত প্রাসাদ-চূড়া৷ রচনার ওজস্বিতা এবং বাচনিক নান্দিকতা তাকে এনে দিয়েছিলো 'ঊনবিংশ শতাব্দীর আসকালানির মতো বিরল সম্মানীয় উপাধি৷ উম্মাহর মাঝে ঐক্য স্থাপন, বিশ্বব্যাপী তাদের সম্মিলিত জাগরণ এবং ভ্রান্ত মতবাদ ও চিন্তার অবদমনে লিখে গেছেন মৃত্যুর ফেরেশতা এসে সমুখে দাঁড়ানোর পূর্ব অবধি৷ চিন্তা ও আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোনো স্যাক্রিফাইসের ধার ধারতেন না৷ আকিদার শুদ্ধতার জায়গায় ছিলেন আপসহীন। শিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তা-দর্শনের প্রতিবাদ করেছেন শক্তহাতে৷ অবিরাম কলম চালিয়েছেন তাদের বিভ্রাটপূর্ণ মতাদর্শের ধ্বংস সাধনে৷ মিশর জামিয়াতুল আযহারে যখন প্রাচ্যবিদদের প্রভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, মহামারির মতো বিস্তার ঘটতে থাকে তাদের প্রতি মানুষের মুগ্ধতা, আকাশে-বাতাসে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে যখন প্রাচ্যবিদদের বয়ান-ভাষণ ও রচনার উদ্ধৃতি তখন তিনি উদ্যোগী হয়ে সবার চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিলেন ওরিয়েন্টালিস্টদের তাবৎ জালিয়াতি। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার বিখ্যাত শহর হিমসে জন্মগ্রহণ করেন৷ শত বছর ধরে হিমস নগরীর দাওয়াহ ও দীনী বয়ান-বক্তৃতার দায়িত্বে ব্রত ছিলো যে পরিবারটি সেই পরিবারেই জন্ম আল্লামা মুসতফা সিবায়ীর৷ বলার অপেক্ষা রাখে না— পরিবারটি ছিলো জ্ঞান ও ইলমের উজ্জ্বল আলোক বিভায় ভাস্বর৷ পরিবারেই, বাবার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি৷ তার রচনা ও ভাষণের যে প্রাঞ্জলতা পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার তরুণ-যুবা ও বয়োবৃদ্ধদের মুগ্ধ করে তুলেছিলো বোধ করি তার উৎস পিতারই প্রাথমিক বিদ্যানিকেতন৷ তার পিতারও বিশেষ খ্যাতি ছিল প্রাঞ্জল ও সদালাপী বক্তা হিসাবে৷ পারিবারিক বিদ্যানিকেতনের বাইরে তার প্রথম শিক্ষালয় জামিয়াতুল আযহার। ১৯৩১ সালে তিনি আযহারের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। আযহারে পড়াকালীন নানান শাস্ত্রের প্রতি তিনি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। এবং নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচির বাইরেও তার পাঠ চলতে থাকে নানামাত্রিক বিষয়ে। আযহারে পড়াকালীনই তিনি শাইখ হাসানুল বান্না রহিমাহুল্লাহর মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। এবং তার আদর্শ সামনে রেখে জ্বলে ওঠেন ইটালিয়ান আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনে। ফলস্বরূপ তাকে পুলিশের হাতে বন্দি হতে হয়৷ ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে মিশর সরকার তাকেসহ অন্যান্য বন্দিকে কারাগারে পাঠায়। তিন মাস মিশরে, চার মাস ফিলিস্তিনে এভাবে সাত মাস তাকে বন্দি জীবন কাটাতে হয়। সাত মাস কারাবরণের পর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলবার অবকাশ পান৷ দেশে ফিরে আরও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলেন 'ইখওয়ানুল মুসলিমিন'-এর সিরিয়া শাখা। এক সময় রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি সাফল্যের প্রমাণ রাখেন। বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সংসদসদস্য নির্বাচিত হন৷ কিন্তু সাংসদ হওয়ার পরও সত্য উচ্চারণের অপরাধে (!) দ্বিতীয়বারের মতন তাকে নবী ইউসুফের পাঠশালায় যেতে হয়৷ এবারে তাকে নির্বাসিত করা হয় লিবিয়াতে৷ সিরিয়াকে তিনি অনেক দিয়েছেন৷ বিশেষ করে তিনি যখন মন্ত্রি তখন সিরিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ ইসলামি শিক্ষাকে পৌঁছে দেন অনন্য উচ্চতায়৷ সাংবাদিকতাও করেন অনেকদিন৷ ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮– এই সময়কালে তার সম্পাদনায় চারটি পত্রিকা আলোর মুখ দেখে৷ এ ছাড়া তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলির সংখ্যা ২৮ ছাড়িয়েছে। বয়ান-রচনা-সংগ্রাম— প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লামা মুসতফা সিবায়ী রহিমাহুল্লাহ ছিলেন এক প্রোজ্জ্বল বাতিঘর৷ পথ দেখিয়ে গেছেন অজস্র পথহারা মানুষকে। ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী, উম্মাহর জন্য দরদি দীর্ঘ সংগ্রামমুখর জীবন কাটিয়ে খ্রিস্ট ১৯৬৪ সালে দুনিয়ার যাত্রা শেষ করেন৷ বিপুল পাথেয় সাথে করে নতুন যাত্রা শুরু করেন অফুরান শান্তির এক আলয়ের পানে৷ আমরা তার জান্নাত-জীবনের বিপুলতর 'সমৃদ্ধি' কামনা করছি।