ওশেন লাইনার শিপিং কোম্পানির জাহাজ ড্রিম ইউরোপা। জাহাজটা সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপ যাচ্ছিল। বিশাল কার্গো জাহাজটিতে দু-তিনটা ফুটবল মাঠ এটে যাবে অনায়াসেই। দুদিন হলো বন্দর ছেড়েছে জাহাজটা। বোঝাই কারগো নিয়ে জাহাজটা পাড়ি দেয় সাগর মহাসাগর। জাহাজ ছাড়ার কয়েকদিন পর, নেভিগেশন ডিউটি অফিসার সোনার রাডারে জাহাজের সামনের দিকে কিছু একটা দেখতে পেলো। একটু পর সে বুঝল, এটা একটা বিশাল তিমির ঝাঁক। দীর্ঘ নাবিক জীবনে সে এত বড় তিমির ঝাঁক কোনোদিন দেখেনি। সে জাহাজের গতি কমিয়ে, দিক পরিবর্তনের নির্দেশ দিলো। তিমিগুলোকে পাশ কাটিয়ে জাহাজটা যেন বেরিয়ে যায়। সোনার রাডারে চীফ অফিসার দেখল, সামনের ঝাঁকটা আরোও বড় হচ্ছে। ডানে না বামে যাবে সেটা সে ঠিক করতে পারছিল না। ঝাঁকটা যেন চারিদিক থেকেই আসছিল। চীফ অফিসারের নাম হাসান, সে ছিল বাংলাদেশি। সে এরকম ঘটনার কখনও সম্মুখীন হয়নি। সে তাই অস্বাভাবিক তিমির ঝাঁকটির কথা ক্যাপ্টেনকে জানালো। ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজের ব্রিজরুমে এসে পড়লো। সে এবার জাহাজটাকে একেবারে থামিয়ে দিয়ে উল্টো যেতে নির্দেশ দিলো। ক্যাপ্টেনের নাম কক্স মিলার। সে ছিল ব্রিটিশ। হাসান বললো: ‘কিন্তু ক্যাপ্টেন, থামতে গেলে ততক্ষনে যদি আরও কাছে চলে আসে তিমিগুলো।’ ক্যাপ্টেন, হাসানকে আশ্বস্ত করে বললো: ‘আমার মনে হয়ে, আমরা তিমিদের কোন একটা বাৎসরিক সমাবেশ স্থানের কেন্দ্রে এসে পড়েছি। একটা ডকুমেন্টরিতে দেখেছি, তিমিরা প্রতি মৌসুমে কোন একটা নির্দষ্ট জায়গায় এসে মিলিত হয়। আমরা উল্টো দিকে কিছুটা যেয়ে দিক পরিবর্তন করবো।’ হাসান, আগেই সেকেন্ড অফিসার পিটারকে খবর দিয়েছিল। সে এসে সোনার রাডারটা দেখছিল। জাহাজ থামতে না থামতেই তিমিগুলো জাহাজের একেবারে কাছে এসে গেল। জাহাজ হঠাৎ থেমে যেতে দেখে কিছু ক্রু, জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা হতবাক হয়ে দেখতে থাকল, তাদের জাহাজ ঘিরে আছে অসংখ্য তিমি, ডলফিন আর হাঙর। ক্যাপ্টেন কক্স চুপ করে ব্রিজরুমের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছিল। ইউরোপা পুরোপুরি থেমে গেল, তারপর উল্টো চলতে শুরু করলো। তিমিগুলো খুব দ্রæত এগিয়ে আসছে দেখে ক্যাপ্টেন, হাসান আর পিটারকে বললো: ‘কিছু একটা ঝামেলা আছে এখানে।’ দুজনেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। তারা দুজনেই সোনার রাডারে খুব মন দিয়ে, তাদের চারদিকে ঘিরে ধরা বিশাল এক সামুদ্রিক জীবের জগৎ বিশ্লেষণ করছিল। ক্যাপ্টেন বললো: ‘দ্রæত গতি বাড়াও, ইউরোপাকে দ্রæত চালিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে।’ হাসান, ইউরোপাকে টপ স্পিডে নেয়ার নির্দেশ দিল। জাহাজ চলতে শুরু করতে করতেই তিমির দল জাহাজটাকে ঘিরে ধরল। এমনকি কিছু তিমি জাহাজে এসে বাড়ি দিচ্ছিলো। দু-লক্ষ টন ওজনের ইউরোপার অবশ্য তাতে কিছুই হচ্ছিল না। ক্রুরা জাহাজের চারপাশে তিমিদের এমন তান্ডব দেখে হতবাক হচ্ছিল। এমন সময়ে ইউরোপা, অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠল। হঠাৎ করেই জাহাজের প্রপেলর বিকল হয়ে গেল। দুই লক্ষ টন ওজনের কার্গো জাহাজ ড্রিম ইউরোপা। তার প্রপেলরের পরিধি বিশ ফুট, ওজন চল্লিশ টনেরও বেশি। ওদিকে তিমিগুলোও ছিল বিশাল আকৃতির। নীল তিমিগুলোর একেকটা দুশো টন পর্যন্ত ওজনের। আবার বোহেড তিমিগুলোর মাথা এতই শক্ত যে, তারা আট ইঞ্চি পুরু বরফ মাথা দিয়ে ভাঙ্গতে পারে। তিমিরা জাহাজের প্রপেলর বাড়ি দিয়ে প্রপেলর নষ্ট করে দিল। প্রপেলরের আঘাতে মারাও গেল অনেক তিমি। জাহাজের পেছনের দিকের পানিতে তিমির রক্ত ভেসে উঠল। চারপাশে ভেসে উঠল কিছু মরা তিমি। ব্রিজরুমের সকলে তাকিয়ে ছিল ক্যাপ্টেন কক্সের দিকে। ক্যাপ্টেন, পিটারকে জাহাজের বাকি ক্রুদের সাথে যোগাযোগ করতে বললো। হাসানকে বললো সমস্ত বিষয় তাদের জাহাজ কোম্পানির হেড অফিসে জরুরি রিপোর্ট করতে। সে নিজে তার জাহাজের মালিক পক্ষের সাথে যোগাযোগের করলো। ড্রিম ইউরোপা অচল হয়ে ভাসতে থাকল মাঝ সাগরে।