এ এক প্রকৃতির গল্প। প্রকৃতির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের গল্প। সভ্য সমাজের বাইরে থাকা প্রান্তিক, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর গল্প। কিংবা একজন প্রকৃতিপ্রেমীর চোখে সৃষ্টিবিনাশ, আর প্রকৃতি ধ্বংসের এক ট্র্যাজিক স্টোরি। বিভূতি মশাই যে অতি উচ্চ মানসিকতার মার্জিত মানুষ ছিলেন, সেটার তার বইয়ের চরিত্র দেখলেই বোঝা যায়। সত্যচরণের মত এত মানবিক, নস্টালজিক, প্রকৃতিপ্রেমী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, ভাবা যায়! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো যে, যেই লোক হাজারীর মত চরিত্র সৃষ্টি করতে পারে, তার দ্বারা সত্যচরণ সৃষ্টি করা কঠিন কিছু না। আর এটা কোনো উপন্যাসের কাতারেই পড়ে না। কোনো ভারী আখ্যান নেই, নেই কোনো শক্তপোক্ত চরিত্র, মানসিক-সাংসারিক টানাপোড়েন নেই। ও হ্যা, লেখকই তো প্রারম্ভে বলে দিয়ে গেছেন এটা। তবে এটায় লেখক তার যেই মোক্ষম অস্ত্রখানা প্রয়োগ করেছে, সেটা হলো 'হিপোটানাইজম'। সত্যচরণ যেমন হিপোটানাইজ হচ্ছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, ঝর্ণার কলকল ধ্বনি, লবটুবিয়ার জনমানুষের বিচিত্রতায়, জোৎস্নার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে, ঠিক তেমনি আমিও হিপোটানাইজ হয়েছি প্রকৃতি আর সত্যচরণের গুন-রুপে। কাহিনির আগাগোড়া শুধুই প্রকৃতি। সাথে আছে জন বিচিত্রতা। বইটাকে এর ধরন অনুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমাংশে সত্যচরণ ধাতস্থ হয়েছেন ফুলবাড়ি বইহারে, আর মুগ্ধ হয়েছেন বন্য সৌন্দর্যে। দ্বিতীয়াংশে লেখক বুদ হয়েছেন মনুষ্য বিচিত্রতায়। আর তৃতীয় অংশ তো শুধুই ট্র্যাজেডি, ডিপ্রেসিভ। এতে আছে ভানুমতীর মত প্রকৃতির কন্যা—আর্য বংশধর, যুগলপ্রসাদের মত বৃক্ষানুরাগী, বৈঙ্কলের মত কাব্যানুরাগী, নৃত্যশিল্প অনুরাগী ধাতুরিয়া কিংবা কুন্তা-মঞ্চীর মত এস্থেটিক চরিত্র।কখনো গাঙ্গোতো'দের তিন মাস পর ভাত খাওয়ার উচ্ছাস দেখিয়া ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসি উঁকি দিচ্ছে, কখনো অরণ্যভূমি বিরাণ হয়ে যাওয়া দেখে মুখ গোমড়া হয়ে আসছে — এটাই বিভূতিভূষণের জাদুকরী লেখার সার্থকতা। লেখক বইয়ের ভেতর যে বার্তা দিয়েছে, তাতে যে কেউ আমার মত বুদ হয়ে যাবে প্রকৃতির প্রেমে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।