বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রকৃতি নিজেই চরিত্র। প্রাণময়। কিন্তু আদর্শ হিন্দু-হোটেল-এ মানুষের জীবনই প্রধান ও প্রখর হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হাজারি নিপীড়িত হয়, মিথ্যা চুরির অপবাদে পর্যুদস্ত হয়। তবু সে স্বপ্ন দেখে। খুব ব্যস্ত একটি রেলস্টেশন আর তার কাছে একটি ভাতের হোটেল, মূল ঘটনা এখানেই। শারীরিক কষ্ট, অনাদর আর অপমানে ক্লান্ত হাজারি তার সামান্য অবকাশ পার করে না সহকর্মী রতনঠাকুরের মতো গা এলিয়ে দিয়ে বা স্টেশনের ব্যস্ততা দেখে। সে চলে যায় চূর্ণী নদীর ধারের ঠাকুরবাড়িতে, কিংবা রাধাবল্লভ-তলায় নাটমন্দিরের নিভৃতিতে। স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতের। এমন কিছু উচ্চাশা নয় তার। হোটেলে কাজ করতে করতে সে গ্রাহক-ঠকানো দেখে। ডাল কম পড়লে তাতে ফ্যান মিশিয়ে দেয়, বাসী মাছ কড়া করে ভেজে চালিয়ে দেয় পরের দিন। এগুলো তার সরল মনকে আলোড়িত করেছে। সে ভেবেছে নিজেই একটা হোটেল করবে। সে হোটেলে এমন লোক-ঠকানো কাজ সে করবে না। সে হোটেল করেছে, জীবনে সাফল্য এসেছে, কিন্তু তার সরল সাধারণ মনটি হারিয়ে যায়নি। ব্যবসায়িক সাফল্য কিংবা বোম্বাইয়ের ডাক তাকে বিচলিত করেনি; বিচলিত করেছে তার প্রতিপক্ষ পদ্মদিদির প্রণতি : বিদায়বেলায় তার পা ছুঁয়ে তাকে প্রণাম করে যাওয়া। এই প্রণতিই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এই উপন্যাস তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব, যিনি তাঁর দেশটিকে চোখ খুলে দেখেছেন, ভালোবেসেছেন; তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নানা দিক গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।