মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে অরণ্য একটা কথা ভাবে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো মানুষের জীবনে যতটুকু সুখ থাকে তার বিপরীতে ততটুকু দুঃখই থাকে কি না। নিজের বেলায় কখনো না ঘটলেও, অনেককেই দেখেছে এরকম পরিস্থিতিতে। আবার অনেককে দেখেছে যাদের জীবনে সুখ বলতে কিছু নেই, দুঃখেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। অনেককে দেখেছে যাদের জীবনে দুঃখ বলতে কিছুই নেই, খালি সুখ আর সুখ। পৃথিবী না-কি সমতা পছন্দ করে। যদি এটা সত্যি হয়েই থাকে, তবে তো সুখ-দুঃখ সমানই হওয়ার কথা! আজকে অনেকদিন পর নিজের একটা পছন্দের জায়গায় এসেছে অরণ্য। মেট্রোরেলের তিন নম্বর স্টেশনের নিচে। সামনে লেক, গাছগাছালি আর শীতের হিমেল হাওয়ায় বেশ ভালোই লাগছে ওর। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে মুখে একটা সিগারেট গুঁজে দিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো অরণ্য। এই স্টেশনটার সাথে বেশকিছু স্মৃতি জমা আছে ওর। সারার কথা মনে পড়ছে ওর। সারা ওর একমাত্র প্রাক্তন। এখন প্রাক্তন হলেও, সম্পর্ক থাকাকালীন ও-ই ছিল অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। সিগারেটটায় একটা টান দিতেই অরণ্যের চোখ গেল একটা প্রাইভেট কারের দিকে। প্রাইভেট কার থেকে নামছে অবিকল সারার মতো একজন। অবশ্য অবিকল বললে ভুল হবে, বয়সটা পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। তার কোলে অবিকল সারার মতোই একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা হঠাৎ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিতেই অরণ্য নিজেকে আবিষ্কার করলো বিমানের সিটে। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল। বোতল থেকে পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো ও। অরণ্যের সাথে সারার পরিচয় কম হলেও ছয়-সাত বছর আগে। সেই কলেজে থাকাকালীন ওদের বন্ধুত্ব শুরু। প্রথমে বন্ধুত্ব, পরে প্রেম। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করেছে ওরা। লোকে বলতো, এরা অনেক লাকি। মানুষের নজরেই কিনা, তিন বছর পর হঠাৎ করেই বিচ্ছেদ হয়ে যায় ওদের! কী থেকে কী হয়ে গেল, আজও অরণ্য বুঝে ওঠেনি। আজও ওর কাছে এটা অনেকটা রহস্যের মতোই। বিচ্ছেদটা যখন হয়, তখন ওর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলে। কোনোমতে ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়ে অরণ্য বিদেশে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। মূলত সারাকে ভুলে থাকতেই অরণ্য এত তোড়জোড় করছিল। অবশেষে বিদেশে চলেও যায়। এতদিন সারার কথা ওভাবে মনে পড়েনি। তবে আজ যখন দেশে আসছে, তখন কেন জানি সারার কথা বারবার মনে পড়ছে ওর। হয়তো অবচেতন মনের খেলা! এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অরণ্য সিটের সামনে থাকা স্ক্রিনে মুভি দেখতে শুরু করলো। মুভিটা অরণ্যের আগে অনেকবার দেখা, বেশ পছন্দেরও। মাটি হতে কয়েক হাজার ফুট ওপরে নিজের পছন্দমতো মুভি দেখতে আলাদা টাকা দিতে হয়। অরণ্য সেটা দিতে নারাজ। এ কারণেই এয়ারলাইন্সের প্রি-সিলেক্টেড মুভিগুলোর মধ্যে আগে দেখা একটি মুভি সিলেক্ট করেছে ও। হাতে যদি পপকর্ন থাকতো, মন্দ হতো না। বিদেশে থাকা অবস্থায় বলা যায় অরণ্য পপকর্ন খেয়েই অনেকদিন কাটিয়েছে। দাম খুব একটা বেশি নয়, তার ওপর একটু খেয়ে একগ্লাস পানি খেলেই পেট ভরে যায়। নিজের জন্য টাকা খরচ করার অনাগ্রহটা এখনো আছে ভেবে মুচকি হাসল ও। অরণ্যের এই অনাগ্রহটা শুরু হয়েছে যখন থেকে অরণ্য টাকা উপার্জন করতে শিখেছে। আগে বাবা-মায়ের টাকা নিজের জন্য খরচ করতে ওর গায়ে লাগতো না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে যখন দুই-একটা টিউশনি করে টাকা উপার্জন করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই নিজের জন্য টাকা খরচ করার কেমন যেন একটা অনীহা চলে এসেছে ওর। টিউশনি থেকে যা পেত, হয় পরিবারের জন্য কিংবা প্রেমিকার জন্য এটা ওটা কিনে খরচ করে ফেলত ও। নিজের জন্য তেমন কিছুই খরচ করতো না। বিদেশে গিয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকলেও কেন জানি এখনও টাকা খরচ করতে দ্বিধা করে ও। অবশ্য এই খরচটা যদি নিজের জন্য না হয়ে অন্য কারো জন্য হতো, তবে এই দ্বিধা যে কোথায় হারিয়ে যেত, কে জানে!