মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পদ্মানদীর মাঝি’ কালজয়ী এক উপন্যাস। ১৯৩৬ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম ‘কেতুপুর’ আর পার্শ্ববর্তী গ্রামের জেলে ও মাঝিদের জীবন-আখ্যান, তাদের নিত্যজীবন; সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম; অসহায়ত্ব ও দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ যেন জেলে-মাঝিদের জীবনের এক স্পষ্ট ও স্বচ্ছ চিত্র। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা যায় কুবের মাঝিকে। সাংসারিক টানাপোড়েন, হতাশা ও দুঃখ-বেদনায় জর্জরিত কুবের পদ্মা নদীর একজন মাঝি। কুবেরের চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই পদ্মার মাঝিদের চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি কিছু না। দু’বেলা পেটভরে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে পরম পাওয়া। হোসেন মিয়া―কেতুপুর গ্রামের এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব; জেলেপাড়ার সকলের মনে হোসেন মিয়াকে নিয়ে ভীতি কাজ করলেও বিপদ-আপদে হোসেন মিয়াই যেন তাদের একমাত্র আশ্রয়। হোসেন মিয়া একটি দ্বীপ কিনেছেন। নাম ময়নাদ্বীপ। তার একমাত্র আশা ময়নাদ্বীপে একদিন বসতি হবে। এছাড়াও উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে রয়েছে কপিলা, কুবেরের চিরপঙ্গু স্ত্রী মালা, গণেশ, ধনঞ্জয় এবং রাসু। ‘পদ্মানদীর মাঝি’―পদ্মার তীরবর্তী জেলেপাড়ার প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের এক অনবদ্য জীবনগাথা। আমরা আশা করি, ‘পদ্মানদীর মাঝি’র পাঠক সমাবেশ সংস্করণ সকল পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।