নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ (সাঃ) এ বীরপুরুষ, কিন্তু রেকানা বিন আবদ ইয়াজিদের কাছে তিনি কিছুই না। রেকানা যেমন বিরাট পালোয়ান, মশহুর বীর, তেমনি মোটাসোটা দৈত্যের মতো বিশাল তার দেহ। দেখলেই ভয় ধরে যায়। শারীরিক শক্তি দিয়ে তাকে ধরাশায়ী করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। এই রেকানা বিন আবদে ইয়াজিদ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র চাচা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। আরবের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগির হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন তিনি। দেশের সাধারণ কুস্তিগিররা তার সাথে লড়ার সাহস পেত না। নামকরা কুস্তিগিররা তার সঙ্গে লড়তে এসে এক পাকড়ানোতেই ধরাশায়ী হয়ে যেত; আর উঠার সুযোগ পেত না। রেকানার স্বভাবটা ছিল বন্য প্রকৃতির, শুধু মারধর আর লড়াই করাই জানত। খালিদের সেই সময়ের কথা মনে পড়ছে, যখন মুসলমানদের বিরক্ত করতে একদিন তিন-চারজন লোক রেকানাকে ধরল। তারা রেকানা কুস্তিগিরকে ভালোমতো খাইয়ে-দাইয়ে বলল—’তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদকে কেউ পরাস্ত করতে পারে না। তাঁর সাথে লড়তে গেলে সে বাহাদুরের মতো অসি চালায়, কাউকে ভয় পায় না। জনগণ তাঁর কথার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি তাঁকে সোজা করতে পারো না?’ রেকানা নেশায় মহিষের মতো ফোঁস করে উঠল। গর্বের সাথে বলল—’তোমরা কি আমার হাত দিয়ে তাঁর হাড্ডি গুঁড়ো করাতে চাও?’ তাঁকে নিয়ে এসো আমার সামনে।’ তারপর কী মনে হতে বলল—’আরে, তাঁকে আনবে কী, সে তো আমার নাম শুনেই মক্কা ছেড়ে পালিয়ে যাবে। না, না, তাঁর সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে ছোটো করতে পারব না।’ সে উসকানিদাতাদের কথায় রাজি হলো না। বলল—’আমি কোনো বীরকেই আমার সমকক্ষ মনে করি না, আর কিনা… না, না, এ অসম্ভব!’ রেকানার কথায় মুসলিমবিদ্বেষীরা সকলেই চুপ হয়ে গেল। তারা চিন্তা করতে থাকল, কেমন করে আল্লাহর রাসূলকে পরাজিত করা যায়। মক্কার ইহুদিরা রাসূলের ঘোরতর দুশমন ছিল, কিন্তু তারা প্রকাশ্যে সামনে আসতে চাইত না। মহানবি (সাঃ)র কারণে কুরাইশ সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তারা মনে মনে খুশি ছিল। তারা যখন শুনল— কুরাইশের কিছু লোক রেকানা কুস্তিগিরকে রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য উত্তেজিত করতে গিয়ে বিফল হয়েছে, তখন তাদের মনে এক শয়তানি খেয়াল চাপল। একদিন রাতে রেকানা এক নির্জন গলি দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তার সামনে পড়ল এক ইহুদি যুবতি। চাঁদনি রাতে রেকানাকে চিনতে পেরে যুবতি খিলখিল করে হেসে উঠল। রেকানাও কম বর্বর ছিল না। সে দাঁড়িয়ে মেয়েটির রাস্তা আগলে ধরল। ‘তুমি হাসলে কেন?’ ‘তুমি কি জানো না, মেয়েরা পুরুষকে দেখে হাসলে তার অর্থ কি হয়?’ রেকানা জিজ্ঞেস করল—’তুমি কে?’ ‘আমি সাবাত বিনতে আরমান।’ ‘ও, ইহুদি আরমানের মেয়ে!’ রেকানা মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে বলল—’তোমার কী আমার দেহ পছন্দ, না আমার শক্তি?’ ‘তোমার দেহটা দশাসই ঠিক, তবে শক্তির বড়াই আর করো না। তুমি তো তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদকেও ভয় পাও!’ ‘কে বলে আমি ভয় পাই?’ রেকানা গর্জে উঠে। ‘সবাই তো বলে!’ সাবাত ধীর কণ্ঠে বলল—’যদি তুমি মুহাম্মাদকে পরাজিত করতে পারো, তবেই আমি তোমাকে এ দেহ পুরস্কার দিতে পারি। হাতির মতো দেহধারী না-মরদ আমি মোটেই পছন্দ করি না।’ ‘আমি আমার সন্তানের কসম দিয়ে বলছি! তোমার শর্ত পূরণ করেই আমি তোমার সামনে আসব।’ রেকানা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল—’কিন্তু তুমি ভুল শুনেছ, আমি মুহাম্মাদকে মোটেই ভয় পাই না। মূলত কথা হলো—আমি দুর্বলের সাথে লড়াই করা নিজের জন্য অপমানজনক মনে করি। কিন্তু তুমি যখন বলছ, তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করবই।’ এরপর রেকানা গেল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র কাছে। রাসূল (সাঃ)-কে লক্ষ করে বলল— ‘ভাতিজা! শুনলাম তুমি নিজেকে খুব শক্তিধর মনে করছ? তুমি নাকি নিজেকে আল্লাহর নবি মনে করো, আর নিজেকে নবি মনে করো বলে আমাদের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবো? কিন্তু পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় শক্তি পরীক্ষায়। এসো, আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এসো! লড়াইয়ে যদি তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারো, তবে আমি তোমাকে আল্লাহর নবি মেনে নেব।’ সে রাসূল (সাঃ) কে যুদ্ধে প্রলুব্ধ করার জন্য আরও বলল—’আল্লাহর কসম! যদি তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারো, তবে আমি তোমার ধর্ম গ্রহণ করব।’
আসাদ বিন হাফিজ (জন্ম: জানুয়ারী ১, ১৯৫৮)গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত বড়গাও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ হাফিজউদ্দীন মুন্সী এবং মাতা জুলেখা বেগম। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং ছড়াকার হিসেবে পরিচিত। তিনি আদর্শিক দিক দিয়ে ফররুখ আহমদের অনুসারী। তাঁর সাহিত্যে বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণ এবং বিপ্লবের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৃজনশীলতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার সাহিত্যে বিপ্লবী চিন্তা-চেতনারও প্রকাশ ঘটেছে। তিনি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত আছেন। কবি আসাদ বিন হাফিজ ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক(সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮৩ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনা ইত্যাদি সাহিত্যের সব শাখাতেই কবি আসাদ বিন হাফিজ রেখেছেন তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। তিনি প্রায় ৮১টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। কবি আসাদ বিন হাফিজ তার বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।