১৯৭৬ সালে ড. মরিস বুকাইলির ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ বইটি প্রকাশের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় অর্ধশতাব্দী। এর মাঝে পৃথিবীর বহু ভাষায় লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে এ বইটি, জনপ্রিয় হয়েছে ইসলামি দুনিয়ায়; ‘বুকাইলিজম’ নামের নতুন এক ধারাই তৈরি করে ফেলে এ বই, যেখানে রয়েছে ধর্মকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণের প্রয়াস। সত্তরের দশকের খ্যাতনামা এ বইটিতে একজন ক্যাথলিক চিকিৎসক ও গবেষক আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে খতিয়ে দেখেছেন- ইহুদীদের হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট, খ্রিস্টানদের গসপেল- এগুলো কতোটা সঠিক? বাইবেল কি ভুলের উর্ধ্বে? ইসলামের সর্বশেষ আসলামি কিতাব কুরআনে কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল রয়েছে? তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের এ বই তৎকালীন ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের জন্য খুলে দেয় এক নতুন দিগন্ত। কিন্তু, বিজ্ঞানের আলোকে ধর্মবিশ্বাস যাচাই কি সঠিক পদ্ধতি? তবে, এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পর হালনাগাদ হয়েছে বিজ্ঞান, হয়েছে আধুনিক থেকে আধুনিকতর, বদলেছে প্রযুক্তি, মানুষের হাতে হাতে উন্মুক্ত এখন ইন্টারনেট দুনিয়া; বদল এসেছে মানুষের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও। পঞ্চাশ বছর পরের আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ বইটি কি এখনও হালনাগাদ? তার চেয়েও বড় কথা, গত অর্ধশতাব্দী সময়কাল জুড়ে ইসলামি সাহিত্যজগতে তুমুল জনপ্রিয় এ বইটির পর্দার আড়ালের আরেকটি অপ্রকাশিত তথ্যও পেয়ে যাবেন নতুন এ সংস্করণে, যেটি কিনা প্যারিসের মূল প্রকাশনী থেকে সরাসরি অনুমোদিত বাংলা অনুবাদ। চলুন, সময়ের পরিক্রমায় আরেকবার ফিরে দেখা যাক বিজ্ঞানের চোখে এ ধর্মগ্রন্থদুটোকে, যার অনুসরণ করে পৃথিবীর ৩৮০ কোটি ধার্মিক মানুষ। আর জেনে নেয়া যাক অপ্রকাশিত তথ্য, সাথে নানা সংযোজনী ও টীকা।
ড. মরিস বুকাইলি ১৯২০ সালের ১৯ জুলাই ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। ফ্রেঞ্চ সোসাইটি অব ইজিপ্টোলজির (মিশরত্ত্ব) সদস্য এই চিকিৎসক একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞও ছিলেন। বিশ্বজুড়ে তিনি একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি সৌদি বাদশা ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজের পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন ১৯৭৩ সালে। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ড. বুকাইলির কাছে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। তিনি মেডিসিন চর্চা করেছেন ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। তবে তাঁর কর্মজীবন শুধু চিকিৎসা জগতেই সীমাবদ্ধ নয়, নাম কুড়িয়েছেন একজন প্রসিদ্ধ গবেষক হিসেবেও। মরিস বুকাইলি ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কের একজন একনিষ্ঠ গবেষক ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম, বিশেষত ইসলাম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোর বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ। এই গবেষণা চলাকালে তিনি বিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক মতবাদ ও পদ্ধতির সাথে কোরআনে উল্লেখিত বক্তব্যের সাদৃশ্য দেখতে পান। অতঃপর প্রকাশিত হয় মরিস বুকাইলির বই ‘বাইবেল, কুরআন এন্ড সায়েন্স’। এই বইয়ে তিনি দেখান যে, কোরআন একটি ঐশ্বরিক গ্রন্থ, যাতে বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক তথ্য রয়েছে। এই মতবাদ থেকে জন্ম নেয় ‘বুকাইলিজম’ বা বুকাইলিবাদ। ড. মরিস বুকাইলি এর বই সমগ্র বিশ্বব্যাপী সাধারণ পাঠক ও গবেষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘বাইবেল, কুরআন এন্ড সায়েন্স’ বিশ্বের প্রায় ১৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আরো প্রকাশিত ড. মরিস বুকাইলি এর বই সমূহ হলো ‘দ্য কুরআন এন্ড মডার্ন সায়েন্স’, ‘হোয়াট ইজ দ্য অরিজিন অব ম্যান’, ‘মাম্মিজ এন্ড ফারাওজ: মডার্ন মেডিকেল ইনভেস্টিগেশনস’ ইত্যাদি। মরিস বুকাইলির রচিত বইগুলোর বেশিরভাগই ফরাসি ভাষায় লেখা, তবে ইংরেজিতেও তাঁর রচনা আছে। প্রখ্যাত এই লেখক, গবেষক ও চিকিৎসক ১৯৯৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন।