"দত্তা” শরৎচন্দ্রের কালজয়ী রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে আজও একইরূপে সমাদৃত প্রকাশের এত বছর পরেও। বাংলার এই জনপ্রিয় লেখক তার লেখনীতে সব সময়ই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের অসামঞ্জস্যতা, দারিদ্র্য, অবহেলিত নারীদের দুঃখগাথাসহ বিভিন্ন সামাজিক ক্ষতগুলোর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। "দত্তা” রোমান্টিক উপন্যাস হলেও তাই এটি অন্তঃর্নিহিত অনেক তাৎপর্যই বহন করে, যা গভীরভাবে উপলব্ধির বিষয়। বিশিষ্টজনেরা এর মূলভাব বহুভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছেন বহু বছর ধরে। মানুষ বড়ো হওয়ার সাথে সাথে পারিপার্শ্বিকতার পাশাপাশি তাদের চিন্তাভাবনা এবং স্বপ্নের মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কখন কার জীবন কী রূপে পরিবর্তিত বা আবর্তিত হবে, কখন কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। এই উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে ঠিক এই ম্যাসেজটা দিয়েই এবং এর মিল বাস্তবজীবনের সাথে প্রতি মুহূর্তেই লক্ষ্যনীয় বলে দেখে এসেছি। কিন্তু বড় হয়ে এক সময় তারা এ প্রতিজ্ঞা ঠিক ভুলে গেল। বনমালীবাবু, রাসবিহারী ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়ে বিয়ে করে কলকাতা পাড়ি জমাল আর জগদীশ তার হিন্দু ধর্ম আঁকড়ে ধরে সেই পাড়া গায়েই পড়ে রইলো, হতদরিদ্র জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলতে লাগল। অথচ এই জগদীশই তিন বন্ধুর মাঝে সবচেয়ে সেরা ছাত্র ছিল, তাই তাকে নিয়ে আশা ভরসা বেশি ছিল সবার যে, এক সময় বন্ধুটি অনেক ভালো কিছু করবে। বনমালীবাবুই ছিলেন তাদের মাঝে সবচেয়ে প্রতাপশালী, গ্রামের জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিশাল জমিদারি ছিল তার, কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল তাকে জমিদারি রেখেই। তখন থেকেই তার জমিদারির সব দেখাশোনা করত আরেক বন্ধু রাসবিহারী, পরে সেই দায়িত্ব পালনে যোগ দিয়েছিল রাসবিহারীর ছেলে বিলাসবিহারী। তারা এক সময় দেখাশোনা করতে করতে বনমালীবাবুর জমিদারিতে অনেকটা নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।