বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসসমূহের পাশাপাশি তাঁর ছোটগল্পগুলোও পাঠক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। সেকালের রীতিনীতি, বিচার-আচার, শিল্প-সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্ন সম্পর্ক, গ্রামবাংলা, ভৌতিক রহস্য—এসকল বিষয়ের দেখা মিলবে তাঁর ছোটগল্পে। ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ শীর্ষক এই সংকলনে স্থান পেয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঠেরোটি ছোটগল্প যেখানে রয়েছে ‘জলসত্র’, ‘মেঘমল্লার’, ‘পুঁই মাচা’, ‘কিন্নর দল’-এর মতো বিখ্যাত গল্পসমূহ। প্রতিটি গল্পই আপনার পাঠক হৃদয়কে নাড়া দেবে। এছাড়াও এ সংকলনে স্থান পেয়েছে ‘মৌরীফুল’, ‘ক্যান্ভাসার কৃষ্ণলাল’, ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’, ‘একটি ভ্রমণকাহিনী’, ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’, ‘কনে দেখা’ নামক গল্পসমূহ। ‘মানুষ হার মানতে জানে না’—এই কথাটির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ‘ক্যান্ভাসার কৃষ্ণলাল’ গল্পে। ‘মৌরীফুল’ গল্পে আমরা দেখি এক মৌরীফুলকে। সুশীলা তার নাম, যার ভাগ্যের পরিহাস মেনে নিতে পাঠকেরও কষ্ট হয়। ‘কনে দেখা’ গল্পে লেখক প্রকৃতিকে দেখিয়েছেন এক নতুন রূপে। লেখক প্রতিটি গল্পই লিখেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। প্রতিটি গল্পেই তিনি জীবন ও চারপাশের মানুষকে দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এ যেন জীবনের অন্য এক রূপ যেখানে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর আনন্দ-বেদনার দেখা মেলে। শ্রীপ্রমথনাথ বিশী বলেছেন, “বিভূতিভূষণের বিশ্ব একটি সুবৃহৎ ও সুবিচিত্র খেলাঘর; তাহার অধিবাসীরা সকলেই বালক-বালিকা, সেখানকার পাহাড়পর্বত অরণ্য প্রান্তর সবই খেলাঘরের মাপের।” তাঁর মতে, “তিনি কৈশোরের কবি, সরল, সৌন্দর্যের সন্ধানী।” আশা করি বইটি পাঠক আদৃত হবে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।