বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিক কবিতার একটি অসাধারণ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যে কবিতাগুলো কাল অতিক্রম করে মহাকালের হয়ে যায়, সে কবিতাগুলোও কোনো না কোনোভাবে আধ্যাত্মিক। লক্ষ্য করার বিষয় হলো- কবিতা টিকে থাকার যতগুলো লোয়াজিমা আছে তার উল্লেখযোগ্য হলো আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিক যোগ না থাকলে সে কবিতা হয়তো তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয়। কিন্তু সে আনন্দ স্থায়ী হয় না। তাৎক্ষণিক আনন্দ নিয়ে সে কবিতা হারিয়ে যায়। আধ্যাত্মিকতা ফুলের সুগন্ধির মতো। একটি ফুল যত নান্দনিক হোক, তার গন্ধ যদি সুবাসিত না হয় তবে ফুলপ্রেমীর কাছে তার গুরুত্ব থাকে না। ফুল তার সৌরভের কারণেই আদরণীয় হয়ে ওঠে। ফুলপ্রেমী ভালোবাসে তাকে। গ্রহণ করে হৃদয়ের গহিন থেকে। ফুলের ঘ্রাণই ফুলকে দামি করে। সৌন্দর্য করে আকর্ষণ। কবিতার সৌন্দর্য হলো উপমা চিত্রকল্প এবং উপস্থাপনা। আর আধ্যাত্মিকতা হলো কবিতার ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণ মিশে থাকে বাণীর সঙ্গে। বাণীর গাম্ভীর্যতা এবং মর্ম কবিতাকে কাল থেকে কালান্তরে নিয়ে যায়। যুগ থেকে নিয়ে যায় যুগান্তরে। এমনকি শতাব্দী থেকে শতাব্দীও পেরিয়ে যায় কবিতার নদী। ফরিদ উদ্দিন আত্তার তেমনই একজন কবি। যার কবিতা পেরিয়ে এসেছে বহু শতাব্দীর মহা সমুদ্র। দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে এক বিস্ময়কর বহমানতায় চলমান আত্তারের কবিতা। ফরিদ উদ্দিন আত্তারের কবিতার আধ্যাত্মিক চেতনার রঙ ইসলামিক। ইসলামি আধ্যাত্মের বিস্ময় সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত আত্তারের কবিতায়। তার কবিতার আধ্যাত্মিক চেতনা ইসলামিক হলেও একে গ্রহণ করেছে সকল ধর্মের কবিতাপ্রেমী মানুষ। যারা কবিতাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চায়, গ্রহণ করতে চায় হৃদয় থেকে, তারা সাধারণত উদার দৃষ্টি বহন করেন। সে উদারতা থেকে তারা পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যকে ঠাঁই দেন তাদের হৃদয়ে। একজন কবিও সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ভেঙে সীমাহীনতার জয়গান করেন। তিনি হয়ে ওঠেন উদারতার দৃষ্টান্ত। সে ঔদার্যের উজ্জ্বল উদাহরণ ফরিদ উদ্দিন আত্তার। বিশ্বজুড়ে কবিতাপ্রেমী পাঠকের হৃদয়ে খচিত আত্তারের নামটি। কবিতাবোদ্ধারা বেশ শ্রদ্ধার সাথেই উচ্চারণ করেন আত্তারের নামটি। উল্লেখ করেন ভালোবাসার সাথে। আত্তারের পুরো নাম ফরিদ উদ্দিন আবু হামিদ মোহাম্মদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম বিন ইসহাক আত্তার কাদকানি নিশাপুরি। ছোট নাম মোহাম্মদ। আত্তার নামেই তিনি বিখ্যাত। পিতা ইব্রাহিম। আত্তার হলো আতর বা সুগন্ধি বিক্রেতা। আবার ওষুধ বিক্রি এবং চিকিৎসা পেশাকেও আত্তার বলে। কাদকান পল্লীর এক আধ্যাত্মিক পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। জন্ম নিশাপুরের কাদকানে ১১৪৩ সালে। মৃত্যু ১২৩০ এ। নিশাপুর থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বে ওমর খৈয়ামের কবরের কাছে তার সমাধি। মোখতার নামা তার বিখ্যাত গ্রন্থ। অন্য প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মানতেকুত তেইর, দিওয়ান, আসরার নামা, এলাহি নামা, খসরু নামা ও মুসিবত নামা। তাযকিরাতুল আউলিয়া তার উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থ। মোখতার নামা একটি কাব্য। এটি রুবাই। রুবাই হলো চার লাইনের কবিতা। ফারসি ভাষায় রুবাই-এর বেশ কদর রয়েছে। ফারসিতে এটি কবিতার একটি নান্দনিক দিগন্ত। কবিতার এ ধারা ফারসি ভাষার এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। ওমর খৈয়াম, হাফিজ রুবাই লিখেছেন। তাদের রুবাই খ্যাতি পেয়েছে বিশ্বময়। তবে ওমর খৈয়ামের রুবাই কবিতা পিপাসুদের সবচেয়ে প্রিয়। যদিও রুবাই কবিতার জন্ম তুরস্কে। অর্থাৎ তুরস্কেই প্রথম লেখা হয় রুবাই। তারপর চীনে চাউর হয় এটি। চীন থেকে আসে পারস্যের খোরাসানে। খোরাসানের নিশাপুরে খৈয়াম ও আত্তারের হাতেই বিশ্বময় রুবাই কবিতার বাগান হয়ে ওঠে। তবে আত্তারই প্রথম রুবাই কবিতার শিল্পিত অধ্যায় বিন্যাস করেছেন। তার গ্রন্থ মোখতার নামা একটি চমৎকার উদাহরণ! এ বইটিতে পঞ্চাশটি অধ্যায়। রুবাই সংখ্যা ২২৭৯ টি। যেমন সংখ্যা তেমনই শৈল্পিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল মোখতার নামা। ফারসি কাব্যে সবচেয়ে বেশি রুবাই রচনা করেছেন আত্তার। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা যখন অনুভূতির শৈল্পিক ভাষা পায় সেটি হয় কবিতা। কবিতা কবির অনুভবের নিগূঢ় প্রকাশ। অল্প কটি বাক্যে জীবনের বিস্তীর্ণ পরিসর ব্যাখ্যা করা যায় কবিতায়। যেমন ফরিদ উদ্দিন আত্তারের কবিতা। যেমন তার রুবাই। একেকটি রুবাই চার লাইনের। অথচ চার লাইনে যা বলা হয়েছে তা সত্যি বিস্ময়কর! এরকম প্রতিটি চার লাইনে যেনো জগতের চতুর্দিক জড়িয়ে আছে। আকাশ থেকে পাতাল, মানুষের হৃদয় থেকে মহান আল্লাহর আরশ পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসর। যে কারণে ফরিদ উদ্দিন আত্তারকে বলা হয় রহস্যের কবি। কিংবা রহস্যময় কবিতার কবি। সত্যি এটিই- জগতের গভীর রহস্যকে শিল্পের আনন্দে যখন ভাষায় বেঁধে দেয়া হয়, সেটিই টিকে যায় পৃথিবীর বুকে। যেমন টিকে গেছেন ফরিদ উদ্দিন আত্তার। মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রেম অগাধ, একথা তো জানাই হলো। পাশাপাশি আছে রাসুল স. এর প্রশস্তি, সৃষ্টিজগতের রহস্য উন্মোচনের আয়োজন এবং মহাজাগতিক বিস্ময়ের অনুভব। একটি ভাষার কবিতা আরেকটি ভাষায় রূপান্তর করা সত্যি কঠিন। কেননা প্রতিটি ভাষার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। নিজস্ব নিয়ম এবং কৌশল আছে। মানুষে মানুষে যেমন পার্থক্য, জাতিতে জাতিতে যেমন ভিন্নতা আছে প্রতিটি ভাষায়ও তেমনই পার্থক্য এবং ভিন্নতা আছে। কবিতা হলো একটি ভাষার মৌলিক স্বর। একটি ভাষার উন্নত রূপ হলো কবিতা। যে কারণে কবিতার হুবহু কণ্ঠ অনুবাদে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আসলে কবিতার একটি ভাব ভাষান্তরিত করা হয়। এ বইতেও তাই করার চেষ্টা করা হয়েছে।