ছোটোগল্প নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলমান, ছোটোগল্পের আকার-কলেবর-ধরন নিয়ে মতভেদ চলমান, ছোটোগল্পের শিল্পগুণ-মান-মর্যাদা নিয়ে সমালোচনা দৃশ্যমান। ছোটোগল্পের কাহিনি, বর্ণনা, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ নিয়েও মতানৈক্য দেখা যায়। বর্ণনাত্মক শিল্প, না সংলাপনির্ভর শিল্প, না কেন্দ্রীয় চরিত্রনির্ভর শিল্প, না অনেক চরিত্রের প্রাধান্যশিল্প, না চরিত্রশূন্যশিল্প তা নিয়েও আছে আলোচনা-সমালোচনা। চরিত্রের ঘনঘটা থাকবে, নাকি ন্যূন চরিত্র নিয়ে গল্প অগ্রসর হবে, নাকি গল্পহীন গল্প হবে, নাকি গল্পই থাকবে থাকবে না গল্পের বাইরে মেদকথা তা নিয়েও সাহিত্যবোদ্ধাদের মধ্যে মতান্তর আছে। ছোটোগল্পের এতদিক বিবেচনা করে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে আজও ছোটোগল্পের প্রকৃত সংজ্ঞাটা অধরা থেকে গিয়েছে। তবে সরলমনা, সৌন্দর্যচেতনা, সাহিত্য আশ্বাদনপ্রিয়, সাহিত্যের একনিষ্ঠ সমঝদার ব্যক্তিরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে পাঠ থেকে তৃপ্তিটুকু নিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকেন। ছোটোগল্পে জীবনবোধ, শ্রেয়োচেতনা, সৌন্দর্যবুদ্ধির প্রয়োগ, রূপচেতনা, একটু দ্রোহচেতনা থাকলেই আত্মতৃপ্তি থেকে যায়। বর্ণনা বিচিত্র ও বহুধা না হয়েও, বর্ণনা ও চিত্রণ বিচিত্র না হয়েও, বিচিত্র বর্ণনা ও বহুধা না থেকেও ছোটোগল্পে গল্পের উপস্থিতি থাকলেই ছোটোগল্প স্বার্থক। বর্ণনাত্মক শিল্প অপেক্ষা হঠাৎ আরম্ভ আর হঠাৎ উপসংসার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শিল্প ছোটোগল্প। গল্পহীন বর্ণনার মতো অপকৌশলের আশ্রয় নিলে তা কখনো ছোটোগল্প হবে না যতই তা ক্ষীণতনু হোক, হোক ঝটকায় শুরু ঝটকায় শেষ। ছোটোগল্পের প্রাণভ্রমরা গল্পই, ছোটোগল্পে গল্পের মাংস থাকতেই হবে। সংঘবদ্ধের সদস্যদের ছোটোগল্পকে কালোত্তীর্ণ ছোটোগল্প হিসেবে সার্টিফিকেট প্রদান আর অধিকাংশের ছোটোগল্পকে মানহীন বর্ণনা নীচুতা। সৌমেন দেবনাথের ❝অগ্রবর্তিনী❞ ছোটোগল্পগ্রন্থে মানুষের জীবনবিন্যাস আর দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। জীবনচিত্রের ঘটনাংশই গল্পরূপে প্রকাশ করেছেন তিনি ছোটোগল্পে। মানবচরিত্রের দহন-পীড়ন, ব্যথা-বেদনা, হাস্যরস তাঁর ছোটোগল্পের মূল উপজীব্য। জীবনের বিশিষ্ট খণ্ডাংশগুলোকে তিনি ছোটোগল্পে রূপায়িত করেছেন। নাতিদীর্ঘ সাহিত্য-রূপসৃষ্টি ছোটোগল্পগুলো অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটি তাঁর তৃতীয় ছোটোগল্পগ্রন্থ। ছোটোগল্পগুলোর কাহিনি টানটান, তীব্র গতিবেগসম্পন্ন। গল্পের বর্ণনা, শব্দচয়ন ও অলংকার প্রয়োগ তাৎপর্যবাহী। জীবনকে গভীর ও সূক্ষ্মদৃষ্টিতে অবলোকন করেই ছোটোগল্পগুলোর প্লট নির্মাণ করেছেন তিনি। মানব মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করে কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন গল্পকার। প্রত্যেকটি ছোটোগল্পের ঘটনার ঘনঘটা আর বর্ণনার ছটা নান্দনিক। মন শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন হলেই তবে ছোটোগল্প লেখা সম্ভব। সৃজনশীল না হলে লিখে সৌন্দর্যসৃষ্টি ও আনন্দদান সম্ভব না। সৌমেন দেবনাথের ❝অগ্রবর্তিনী❞ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পে সেই ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফূরণ সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। কাহিনি-কল্পের বিষয়বস্তুও চমৎকার। কাহিনির গতি ও পরম্পরা, উৎকর্ষতা, আকর্ষণীয়তা, উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ, পরিসমাপ্তি সবই সুন্দরতর না হলেও সুন্দর।