৭ই মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে ১৮ বছর বয়সী তরুণ মোসাদ্দেক আযম সিদ্দিকীও ছিলেন। বাসাটাও কাছাকাছি, নিউ এলিফ্যান্ট রোডে। শুনে এলেন, যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার ডাক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠ আহবান: ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই তরুণের সামনে তখন একটি পথই খোলা, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা। তিনি তাই করলেন। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ যেন দেশের জন্য হারিকিরি করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ...আমাদের রাজনৈতিক আলোচনার প্রিয় বিষয়বস্তু ছিল কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, হো চি মিন, ভিয়েতকং গেরিলা ও অনুরূপ বিষয়। এই ১৮-১৯ বছর বয়সে এসব আলোচনার শেষ পরিণতি বৈপ্লবিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। বয়স ও ধারণা-সংকটের কারণেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা মলোটভ ককটেল বা পেট্রোল বোমা বানাব। আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ করলে আমরা এটা দিয়েই ওদের প্রতিহত করব। শুরু হলো ফিউজড্ বাল্ব অথবা কাচের বোতল জোগাড় করা। এরপর এসবের ভেতর পেট্রোল ভরা ও সলিতা লাগানো। কাজ হচ্ছিল বেশ দ্রæততার সঙ্গে, ফলে আমরা জনা দশেক মিলে দিন দুয়েকের মধ্যে শ’খানেক মলোটভ ককটেল তৈরি করে ফেললাম। কয়েকদিন পরে বুঝলাম এগুলো কত শিশুসুলভ, রোমাঞ্চকর এবং কল্পনাপ্রসূত ছিল।’ তারপর সত্যিই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সুদক্ষ প্রশিক্ষকদের কাছে যুদ্ধের ট্রেনিং নিলেন, তিনি হয়ে উঠলেন বিএলএফ-বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের নিয়মিত যোদ্ধা। মোসাদ্দেক আযম সিদ্দিকীর যুদ্ধদিনের কথা যারা পড়বেন তারা অনুধাবন করবেন, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন। নেহায়েত ভাগ্যগুণে তিনি বেঁচে গেছেন এবং আজো বেঁচে আছেন তাঁর জীবনের নিশ্চিত লক্ষ্যে অনিশ্চিত যাত্রা-র কাহিনী শোনাতে। বইটি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে পাঠক উঠবেন না, নিশ্চিত। স্বাধীনতার স্বপ্নের সাথে মানুষের কল্যাণের যে আকাঙ্খা ছিল তার অনেকটাই অপূর্ণ থাকার দীর্ঘশ্বাসও শোনা যাবে এই নিশ্চিত লক্ষ্যে অনিশ্চিত যাত্রা ১৯৭১-এ।