গল্প শোনার দিনগুলো ভাবনাহীন সহজ জীবন মানেই শৈশব। যার শৈশব যত সরল ও আনন্দময়, ব্যক্তি হিসেবে সে তত নির্মল ও মানবিক। শৈশবে প্রিয়জনদের মমতা, কল্পনার বাধাহীন ছুটে চলার ক্ষমতা ব্যক্তিকে করে তোলে অনুভূতিপ্রবণ এবং সৃজনশীল। শৈশবের মধুর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে গল্প। কল্পনায় মেশা কত রকম কাণ্ডকারখানা চলতে থাকে আমাদের শিশুতোষ গল্পের রাজ্যে। যত বেশি কল্পনা, ততই যেন গল্পের মুগ্ধতা। সোনালি শৈশব আরও রঙিন এবং সম্পর্কগুলো আরো নিবিড় হয়ে ওঠে যখন গল্প বলিয়েরা হন নানু-দাদু, ঠাকুমা-দিদিমা বা মায়ের মতন অতি আপনজন। বাংলাদেশের গ্রামে অনেক লোককথা আছে, যা যুগ যুগ ধরে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়। তেমনি কিছু গল্প বা কাহিনি সংকলন আমরা দেখতে পাই দক্ষিণারঞ্জন মিত্র-মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’, জসিম উদ্দীন-এর ‘বাঙালির হাসির গল্প’ এরকম কিছু বইতে। আবার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকরাও শিশুদের জন্য অনেক গল্প লিখে গেছেন। বাংলাদেশেও আছেন অনেক বড়ো মাপের শিশু সাহিত্যিক, যাঁদের গল্প-কবিতা কল্পলোকে নিয়ে যায় শিশুদের। শিশুতোষ সব গল্পেই প্রতিধ্বনিত হয় সত্য ও শুভের জয় এবং অসত্য বা অশুভের পরাজয়। অপরূপ রূপকথার গল্পগুলো যেমন আমাদের অসম্ভব সুন্দরের স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যায়, তেমনি নীতি শিক্ষার গল্পগুলো আনন্দের পাশাপাশি জগৎ ও জীবনের চিরন্তন সত্যেকে উপলব্ধি করতে শেখায়। গল্পের মাধ্যমে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের শিক্ষা তাই আমাদের জীবনপাঠের অংশ। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিস দেশে ক্রীতদাস হিসেবে জন্ম নেওয়া নিরক্ষর কিন্তু বিচক্ষণ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন। জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিনয়ী স্বভাবের জন্য মনিব তাঁকে দাসত্ব থেকে নিঃশর্ত মুক্তি দেন। মুক্ত হয়ে তিনি নদীর ধারে গাছতলায় বসে শিশুদের বিভিন্ন শিক্ষামূলক গল্প শোনাতেন। জীবনের নানা অভিজ্ঞতার আলোকে পশুপাখিকে রূপক করে নানা ধরনের উপভোগ্য গল্প মুখে মুখে তৈরি করতেন। যা সচেতন ও বিবেক সম্পন্ন করে তুলেছে সেকালের এবং একালের মানুষদেরও। শিশুদের প্রিয় এই গল্পকথক যাঁকে আমরা ঈশপ নামে চিনি, তাঁর নীতি-নৈতিকতা শেখানোর গল্পগুলো আজও সারা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। মজার ব্যাপার হলো নিরক্ষর ঈশপ শুধু গল্প বলে গেছেন, কখনো তাঁর গল্পগুলো নিজে লিখে যাননি। গ্রিক ও রোমান লেখকেরা ঈশপের উপ-কথাগুলোকে গদ্য কিংবা পদ্যে ধারাবাহিকভাবে লিখে গেছেন। অসামান্য গল্পকথক ঈশপ অমর হয়ে আছেন তাঁর অসংখ্য গল্প বলার মধ্য দিয়ে।