ছেলেটি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল পোড়োবাড়িটির চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ইটের দেয়ালের আশেপাশে, উপরে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট জংলা গাছগাছালি জন্মেছে। সামনে ভাঙা একটি বিরাট দরজা। যার কোনো পাল্লা নেই। লোকটি এক রকম জোর করে টেনে নিয়ে ছেলেটিকে সেই দরজা দিয়ে ঢুকাল। তারপর দু’তিনটি ঘর, বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের পাশে এসে নিচের দিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। লোকটি এক হাত দিয়ে ছেলেটির এক হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে আছে। বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি নামার পর পাতালের একটা বিরাট ঘরের কাছে এসে থামল। সামনে বড় একটা লোহার দরজা। বড় তালা দেয়া। লোকটি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাশেই ঝুলিয়ে রাখা চাবির গোছাটা হাতে নিয়ে একটি দিয়ে তালা খুলল। তারপর ঘড়ঘড় করে দরজার পাল্লাটা একদিকে সরিয়ে দিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ভিতরে বিরাট হলঘরের মতো জায়গা। ঘরের ভিতরটা আবছা অন্ধকার। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে আস্তে আস্তে ঘরের সবকিছু ছেলেটির নজরে এলো। তবে অন্ধকার বেশিক্ষণ থাকল না। লোকটি সুইচ টিপে একটি লাইট জ্বালিয়ে দিল। এতে ভিতরটা বেশ আলোকিত হয়ে গেল। কারখানার মতো বড় ঘর। এদিকে-সেদিকে বিভিন্ন রকমের লোহা-লক্কর ছাড়াও এটা-সেটা জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একদিকে বেশ কয়েকটি বাঁশের খুঁটি। সেগুলোতে ওর মতো কয়েকটি কিশোরকে হাত পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকটি লাঠির খট্খট্ আওয়াজ তুলে হেঁটে হেঁটে সবগুলো ছেলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরখ করল। দাঁত বের করে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল। টুকটাক কথাবার্তাও বলল। এসব দৃশ্য দেখে ছেলেটির বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ওর সামনে এসে লোকটি দাঁড়ালে ছেলেটি তোতলাতে তোতলাতে জানতে চাইল, ‘আমাকে এখানে এনেছেন কে-কেন?’ লোকটি ছেলেটির দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এবার অন্যরকম ভঙ্গিতে হেসে বলল, ‘পারবে। সময় হলে সব বুঝতে পারবে। আর কোনো কথা নয়।’ তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি তাহলে এদের সঙ্গে আপাতত থাকো। আমি পরে আসব। লাঠির খট্খট্ আওয়াজ তুলে লোকটি বেরিয়ে যাচ্ছে। এ সময় সম্বিত ফিরে পেয়ে ছেলেটি পিছনে পিছনে দৌড়ে গেল। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই লোকটি বেরিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিল। ওপাশে চাবি ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। ছেলেটি হতাশ হয়ে চিৎকার করতে করতে দরজার কাছেই বসে পড়ল। ক্লান্তি শ্রান্তিতে শরীর, মন ভেঙে আসতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর ছেলেটির মনে হলো আরে অন্য ছেলেদের মতো করে তো ওকে বেঁধে রেখে যায়নি। তাহলে এখান থেকে তো বের হওয়ার একটা বুদ্ধি করা যেতে পারে। ও তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। অন্য ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। গুনে গুনে দেখল মোট দশটি ছেলেকে খুঁটির সাথে হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা এখানে এলে কী করে?’ একজন বলল, ‘তোমাকে যেভাবে ধরে এনেছে আমাদেরকেও সেভাবে ধরে এনেছে।’ ‘কিন্তু এভাবে ধরে এনে বন্দি করে রাখার কারণ কী?’ ‘সময়-সুযোগমতো আমাদের অন্য দেশে পাচার করা হবে।’ ‘তাই না কি? এ তো মারাত্মক ব্যাপার। তোমরা জানলে কী করে?’ ‘ওই লোকটির সঙ্গে আরো একটি লোক আছে। তাদের কথাবার্তা থেকে শুনেছি। অন্য লোকটি আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে।’ ছেলেটি মাথা চুলকাতে চুলকাতে কী যেন ভাবল। তারপর ছেলেদের দিকে তাকাল, ‘তার মানে এরা পাচারকারী?’ এবারে অন্য একজন বলল, ‘হ্যাঁ, বিদেশে মানুষ পাচার করে।’ ‘আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে কি এখান থেকে আমাদের মুক্তির কোনো উপায় নেই?’ একজন বলল, ‘তা জানি না।’ আরেকজন বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘আরে উপায় তো আছে। তোমাকে তো দেখছি আমাদের সবার মতো বেঁধে রেখে যায়নি। সম্ভবত লোকটি ভুলে গেছে।’ ছেলেটি বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। আর লাইটও নিভিয়ে যেতে ভুলে গেছে। আমি যখন খোলা অবস্থায় আছি তখন তো বের হওয়ার বুদ্ধি করা যায়।’ অন্যরা সমস্বরে বলল, ‘অবশ্যই। এটাই সুযোগ।’ ‘কিন্তু কিভাবে কী করা যায় তোমরা বুদ্ধি বের করো।’ একজন বলল, ‘কিছুক্ষণ পর ওই লাঠিঅলা লোকটি অন্যজনের সঙ্গে খাবার নিয়ে আসবে। তখন তাদেরকে কাবু করতে পারলে আমরা সহজে এখান থেকে বের হতে পারব।’ অন্য একজন বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক কথা।’ হাত খোলা ছেলেটির উদ্দেশ্যে করে বলল, ‘তোমার যেহেতু হাত খোলা আছে সেক্ষেত্রে তুমি আমাদের হাতের বাঁধন খুলে দাও। আর পিছনে দড়িটা খুঁটির সাথে হালকাভাবে আটকে রাখো। তুমিও এভাবে একটা খুঁটির সাথে পিছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। তাহলে ওরা মনে করবে সবার হাত আগের মতো বাঁধাই আছে। তখন সবাই মিলে আমরা ওদের ধরে বেঁধে ফেলব।’ এবারে অন্য একজন বলল, এতে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তার চেয়ে আগে আমরা সবাই দরজার পাশে লুকিয়ে থাকব। ওরা ঢোকার পর দরজা তো খোলা থাকে, আর ভিতরে যেহেতু আবছা আঁধার আছে। সেক্ষেত্রে ওরা ঢুকেই কিছু করতে পারবে না। আমাদের দেখতে হলে দরজা থেকে ঢুকে কিছুদূর হেঁটে আসতে হবে। ওরা ঢুকে যখন আমাদের দিকে হাঁটা শুরু করবে তখনই বেরিয়ে যাব। আর দরজার কড়ায় তালার সঙ্গে চাবি লাগানোই থাকে। আমরা পাল্লা টেনে দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি তালা লাগিয়ে দেবো।’ সবাই আবার একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, তোমার বুদ্ধিটা ভালো। এটা করা যেতে পারে।’ বাঁধন খোলা নতুন আসা ছেলেটি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ওরা কখন খাবার নিয়ে ঢুকবে? সেটা জানতে পারলে ভালো হতো।’ ‘খাবার দেয়ার সময় হয়ে গেছে। আধাঘণ্টার মধ্যেই হয়তো চলে আসবে।’ ‘তাহলে আমি তোমাদের সবার হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছি। আচ্ছা, খাবার সময় তোমাদের হাতের বাঁধন খুলে দেয় না?’ ‘সবাইকে একসঙ্গে খেতে দেয় না। দুজনের বাঁধন খুলে দেয়। তাদের খাওয়া হলে অন্য দুজনের খোলা হয়। এভাবে দুজন করে খেতে দেয়।’ ‘ও আচ্ছা।’ ছেলেটি কাজ শুরু করল। একে একে সবার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে মুক্ত করল। আর একটু পরেই এই বন্দিদশা থেকে তারা মুক্তি পাবে এই আনন্দে সবার চোখ, মুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল। একজন বলল, ‘এখন কেউ কোনো রকম শব্দ করবে না বা কথা বলবে না। চলো আমরা দরজার পাশে বসে থাকি। ওদের আসার সময় হয়ে গেছে।’ নতুন আসা ছেলেটি বলল, ‘আমরা এখান থেকে বেরিয়ে সবার সাথে সবাই পরিচিত হবো কেমন? তবে আমার নামটা তোমরা শুনে নাও। আমার নাম কবির।’ সবাই বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’ কবির বলল, ‘কিন্তু তার আগে আমার পানি খাওয়া দরকার। খুব পিপাসা লেগেছে।’ একজন বলল, ‘তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি পানি আনছি। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে ঘরের এক কোণা থেকে গ্লাসে করে পানি এনে দিল। কবির বসে পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিল। ছেলেরা আর দেরি করল না। ঝটপট দরজার পাশে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। তার আগে একজন গিয়ে লাইট অফ করে দিল। খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। কিছুক্ষণ পর বাইরে দুজনের কথাবার্তা আর চাবি দিয়ে খুট করে তালা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। একটু পরেই ঘড় ঘড় করে আওয়াজ তুলে দরজার একটা পাল্লা একদিকে খুলে গেল। লোক দুজন ভিতরে ঢুকে। দু’চার পা দূরে যেতেই ছেলেরা নিঃশব্দে এক এক করে বেরিয়ে এলো। তারপর লোকগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই মিলে দরজার পাল্লা টেনে দিল। তালায় চাবি লাগানোই আছে। কবির ঝটপট চাবি ঘুরিয়ে তালা লাগিয়ে দিল। দরজা বন্ধ। দুষ্ট লোক দুটো ঘরের মধ্যে আটকা পড়ল। কবির বলল, ‘এখান থেকে বেরিয়ে আমাদের পুলিশে খবর দিতে হবে। তাহলে দুষ্ট লোকগুলোর উচিত শিক্ষা হবে। কি বলো সবাই।’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ সবাই সমস্বরে জবাব দিল। তারা মুক্তির আনন্দে হইচই, কলরব করতে করতে এগিয়ে চলল। গতকাল আবিরের পায়ের প্লাস্টার খোলা হয়েছে। কিন্তু ও হাঁটাহাঁটি করতে পারছে না। মাটিতে পা রাখা যাচ্ছে না। ডাক্তার কিছু উপদেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে, গরম পানিতে কাপড় ডুবিয়ে ব্যথার স্থানে গরম সেঁক দিতে হবে, কোনো কিছুর সাহায্যে ধীরে ধীরে হাঁটার প্র্যাকটিস করতে হবে। এছাড়াও কিছু কিছু শরীর চর্চার ব্যাপার আছে, সবই আবির মনোযোগ দিয়ে করছে। তবে এতে করে পায়ে ব্যথা হচ্ছে। ডাক্তারের কথা, প্রথম দিকে এক আধটু ব্যথা করলেও পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ব্যথা কমার জন্যও ট্যাবলেট খাচ্ছে। আসলে অনেক দিন প্লাস্টার থাকায় পা একভাবে ছিল। সেজন্য নড়াচড়া করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। রমিজুলের মাকে ধরে আস্তে আস্তে ধীরে এক পায়ে বেশি করে ভর দিয়ে এ ঘর ও ঘর দিনে দু’একবার যাওয়া আসা করছে। গরম পানির সেঁক দিচ্ছে। ওর বিশ্বাস এরকম করে হাঁটাহাঁটির প্র্যাকটিস করলে সুস্থ হতে বেশি সময় লাগবে না। শুধু ব্যথাটাই এক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাড়ি ফাঁকা। বাবা, ছোটমা অফিসে। আবির কিছুক্ষণ আগে রমিজুলের মায়ের সাহায্যে একপায়ের উপর ভর দিয়ে ড্রইংরুমে এসেছে। জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসেছে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এ সময় ও একটা আইসক্রিমওয়ালাকে ঘণ্টি বাজিয়ে যেতে দেখল। আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে ওর খুব আইসক্রিম খাওয়ার লোভ হলো। কেউ যখন আশেপাশে নেই তখন একটা আইসক্রিম কিনে খাওয়া যেতে পারে। কারণ আইসক্রিম খেলে ওর শরীর খারাপ করে। সেজন্য কেউ খেতে দিতে চায় না। যদিও লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনো কিছু খাওয়াটা ঠিক না। তাছাড়া শরীরেরও ক্ষতি হতে পারে। এসব কিছু জেনেও ও আইসক্রিম নিচ্ছে। কেননা লোভ বলে একটা কথা আছে না! তো সেই লোভের বশবর্তী হয়েই আবির এখন এটা করছে। রমিজুলের মা রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে। প্যান্টের পকেটে বাবার কাছ থেকে নেয়া দশ টাকার নোটটাও রয়েছে। আবির আইসক্রিমওয়ালাকে হাতের ইশারায় ডাকল। লোকটি খোলা জানালার কাছে এলে একটা আইসক্রিম দিতে বলে টাকা বের করে দিল। আইসক্রিম দিয়ে লোকটি চলে গেলে ও মনের আনন্দে খেতে লাগল। আইসক্রিম খাওয়া শেষ করার পর রমিজুলের মা ঘরে ঢুকল। ভাগ্যিস আইসক্রিম শেষ হয়ে গেছে। নইলে রমিজুলের মা দেখলে হইচই করত। রমিজুলের মাকে দেখে আবির বলল, ‘আমার এখন একটু বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে। আপনি একটু দাঁড়ান। আপনাকে ধরে ধরে আমি ও ঘরে যাব।’ ‘এইখানে আর বসবা না?’ ‘নাহ, আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বিছানায় একটু শুয়ে থাকলে ভালো লাগবে।’ ‘ঠিক আছে। চলো।’ আবির বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।