ভূমিকা এক কিশোর বালক তার বিধবা মায়ের হাত ধরে হাঁটতেছিল আশ্রয় সন্ধানে। পথে পায়ে হাঁটার ক্লান্তিতে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘মা পথ আর কত দূর?’ কিশোর বালকের এমন প্রশ্ন শুনিয়া পথের দেবতা বক্র হাসিয়া উত্তরে বলেছিল, ‘আর হে মূর্খ বালক, পথ কি এইখানে শেষ হইয়াছে?’ পথ বাজিতপুর গ্রাম পেরিয়ে সোজা চলে গিয়েছে দুই পাশের বিস্তৃত ফসলের মাঠের বুক ছিঁড়ে যে রাঙামাটির পথ গিয়ে উঠেছে খলাপাড়া হাওরের পাড়ে। পরে সেই পথ চলে গিয়েছে হিরনপুর গ্রামে, যেখানে তালগাছ ঘেরা পুকুরের পাড়ের সরু পথ ধরে পথ চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে সিংহের বাংলা গ্রামে, সেখান থেকে পথ গভীর জঙ্গলের গাছগাছালি ডালপালা কেটে যে রাস্তা তৈরি হয়েছে, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর জঙ্গলের দুর্গম পথ পেরিয়ে পথ চলে গিয়েছে কত শত নদ-নদীর পাড় ধরে পথ গিয়ে মিশেছে সেই সীমাহীন সাগরের জলদেশে। সেখানেই কি পথের শেষ? না। তবে পথের শেষ কোথায়? পথের সেই রহস্যের উন্মোচনে যুগে যুগে মানুষ পথে পথে হেঁটেছে জীবনের সন্ধানে। প্লেগ মহামারি, কলেরা, গুটি বসন্ত, ম্যালেরিয়া, কালো জ্বর, করোনা মহামারি মরণ নিয়ে এসেছে। মহামারি মানুষের দেহকে সংক্রামিত করে মরণ দিয়ে মনুষ্য দেহকে আমাদের চোখের আড়াল করতে পেরেছে। কিন্তু পারল কি চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার মানুষের মধুময় স্মৃতি তার নিকটের মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে? যে স্মৃতির জাগ্রত স্মরণে মানুষ অনুপ্রাণিত হয় আবার জীবনের সন্ধানে। পথ চলার পথে পথে জীবনের সকল উত্তাপ ছড়িয়ে চলতে থাকে মরণোত্তর জীবনের গল্প বলব বলে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে কোভিড-১৯ নামক যে মহামারি পৃথিবীর সকল দেশের ন্যায় আমাদের দেশের লক্ষ মানুষকে যেভাবে সংক্রমিত করেছিল আর সেই সংক্রমণে আমরা অনেক আপনজনকে হারিয়েছি। যারা ছিলেন আমাদের জীবনে বটবৃক্ষের মতো—সকল প্রতিকূলতা থেকে ছায়া দিয়ে আড়ালে রেখে বুকের উষ্ণতা দিয়ে আমাদের ঢেকে রেখেছিলেন। আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আমরা যেভাবে আশ্রয়হীন হয়ে গেলাম সেইসব গল্প বলা হয়েছে এই পুস্তকে। তারপর যুক্ত হয়েছে ১৯৬৪ সালে এই পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যে দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়েছিলেন। লক্ষ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও সম্পত্তি ফেলে রেখে নিঃস্ব হয়ে শত জনমের জন্মভিটা ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন। আমার মামার পরিবারও ছিল সেই দেশান্তরী লক্ষ পরিবারের একজন। মায়েরা ছিলেন দুই বোন ও এক ভাই। আমি নিজে ছয় বোনের একমাত্র ভাই। মায়ের রক্তই আমাদের সকল ভাইবোনের ধমণিতে প্রবাহিত। মামার এ হেন দেশত্যাগ এবং ভারতে গিয়ে অভাব অনটনে থাকার সকল সংবাদ মা জ্ঞাত ছিলেন। মায়ের এমন মনঃকষ্ট আমাদের সাথে কখনো ভাগাভাগি করেননি। মামার দেশত্যাগ এবং অভাব অনটনের পরবর্তী ঘটনা মায়ের মনকে কতটা পীড়িত করেছিল সেই সকল অব্যক্ত কথা বলা হয়েছে এই পুস্তকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত পথের পাঁচালির উপন্যাসের শেষ লাইনটি ছিল এমন, ‘চলো এগিয়ে যাই’। আমরাও পথের পাঁচালীর চরিত্রের মতো সম্মুখে এগিয়ে যেতে চাই। পথের পাঁচালী উপন্যাসের একটি চরিত্র লীলা রায় তাহার সখ্য অপুকে অনুরোধ করেছিল একটি গান গাইতে। অপু সেই অনুরোধের উত্তরে রবি ঠাকুরের একটি গান গেয়েছিল। ‘আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসি। ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।’ অনুপ ও আমি আমরা পরস্পর সহকর্মী। অনুপ খাতার কাটা ছেঁড়া দুর্বোধ্য লেখনীকে পাঠতুল্য করেছে। ওর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। অনুপ আমার যেকোনো কর্মকেই নিজের জীবনের বিষয় বলে বিবেচনা করে। একুশের বইমেলায় বইটি আনার উদ্যোগ গ্রহণ করায় চৈতন্য প্রকাশনের কবি রাজীব চেীধুরীর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেন্টু রায় বড়োবাজার, নেত্রকোনা