একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছিল বাংলার অগণিত মায়েরা-বোনেরা। সারা দেশজুড়ে নয় মাসব্যাপী ঘটেছে নির্মম অত্যাচার, যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা হদিশ করা সুকঠিন কাজ। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর জাতির জন্য বয়ে এনেছিল বিজয়, আর নির্যাতিত নারীদের জন্য ছিল আরেক জীবনযুদ্ধের সূচনা। বঙ্গবন্ধুর সরকার নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা হিসেবে বরণ করে তাঁদের পুনর্বাসন এবং মর্যাদার সাথে সমাজে পুনরায় স্থিত করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বীরাঙ্গনাদের জীবনে নেমে আসে আরেক দুর্দৈব, তাঁদের অবদান তুচ্ছ করে বন্ধ করা হয় পুনর্বাসনের সকল আয়োজন, অবহেলা অস্বীকৃতি ও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় বীর নারীদের সম্মানের সাথে বাঁচার প্রয়াস। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে পথ চলে জাতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গণহত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়ে চলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নারী নির্যাতনের সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করেছে, সরকার তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছে বীরাঙ্গনা-মুক্তিযোদ্ধা রূপে। কিন্তু সমাজ এখনো বীরাঙ্গনাদের যোগ্য সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারেনি। সেজন্য আরব্ধ রয়েছে অনেক কাজ। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বীরাঙ্গনার নারীদের জীবন-সংগ্রামের সাথে পরিচিত হওয়া। নিষ্ঠাবান মুক্তিযুদ্ধ-গবেম্বক তাজুল মোহাম্মদ-এর বর্তমান গ্রন্থ পাঠকদের দাঁড় করিয়ে দেবে কয়েকজন বীর নারীর মুখোমুখি। সেটাই গ্রন্থের বড় অর্জন।
তাজুল মােহাম্মদ সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ১৯৭২ সালে। আর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে হাত দেন ১৯৭০ সালে। তখন থেকেই লেখালেখি করছেন এ বিষয় নিয়ে। ১৯৮৯ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “সিলেটে গণহত্যা'। এ গ্রন্থের সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি। সিলেটের যুদ্ধ কথা’-সহ আরও চার-পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৪ সাল অবধি। সিলেটের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক আলােচনার কারণেই হয়তাে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ব্রিটেনের টুয়েন্টি টুয়েন্টি টেলিভিশনের। যােগাযােগ করে সে টিভি কর্তৃপক্ষ। নিয়ােগ করে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গবেষণার কাজে। ৯ মাসের গবেষণার ফল হিসেবে নির্মিত হয় ‘দা ওয়ার ক্রাইম ফাইল’ নামক প্রামাণ্য চিত্র। যা সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বের দেশে-দেশে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে, ব্রিটেনে, যুক্তরাষ্ট্রে। এর আগেই তাজুল মােহাম্মদের ওপর হুমকি আসে মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী এবং জামায়েত শিবিরের পক্ষ থেকে। এক সময় দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। দেশের বাইরে থেকেও আন্দোলন করেছেন তিনি। বসতি গড়েছেন কানাডায়। বছরে কয়েক মাস দেশে অবস্থান করে চালান গবেষণাকর্ম। বাকি সময় কানাডায় বসে লেখালেখি করেন। গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে ষাটের অধিক। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পেয়েছেন ইংল্যান্ডের টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু সম্মাননা। গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন যুবকের ন্যায়। তাজুল মােহাম্মদের জন্মস্থান মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। পরে থিতু হয়েছিলেন সিলেট শহরে।