"আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ" বইটির 'ভূমিকার বদলে' অংশ থেকে নেয়াঃ সেই কবে থেকে-যে মানুষ আপনাকে আপনি দেখতে চেয়েছে। আপন চেহারা। দেহ। অবয়ব। এ এক দুর্মর আকর্ষণ। আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে দেখা, নিজে। গ্রিক পুরাণের নার্সিসাস-এরও আগে থেকে আজ অবধি। যুগ যুগ ধরে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র সময় সামান্য কিছু সফলতা এসেছিলাে—এই নিজেকে দেখার। বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশলের মাধ্যমে। তাঁর সৃষ্ট ক্যামেরা অব্সকুরা’ আলােকচিত্রের প্রাথমিক যান্ত্রিক ভিত্তি। তারপর! ১৮৩৯ খ্রীস্টাব্দে জার্মান জ্যোতির্বিদ জন হার্শেল তাঁর ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার বন্ধু হেনরি ফক্স ট্যালবােটকে চিঠি লেখার সময় সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পরে এঞ্জেলাে সােলা, জোসেফ নিসেফোর নিয়েপস্, লুই আঁ মদে দ্য-গােয়ের, জোসেফ | পিটস, জর্জ ইস্টম্যান প্রমুখ বিজ্ঞানী-গবেষকদের নানা উদ্ভাবনে এর বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয়। অত:পর এই বিশাল চমকৃত-করার-মত আবিষ্কারটির ক্রমবিবর্তনের ধারায় আশ্চর্যজনক অগ্রগতি ঘটে : দেড়শ বছর আগে যেখানে একটি ছবি তুলতে সময় লাগতাে এক ঘণ্টা, সেখানে বর্তমানে তা লাগে এক সেকেণ্ডের পনের লক্ষ ভাগেরও এক ভাগ মাত্র। এ প্রেক্ষাপট অনুধ্যান করে জাহাঙ্গীর সেলিম একটি সুন্দর কাজ করেছেন : এ বিষয়ে বাংলাদেশে পারদর্শী একজন ব্যক্তি মনজুর আলম বেগ-এর জীবনী রচনার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে সূত্রপাত থেকে হাল আমল পর্যন্ত আলােকচিত্রের ওপর লেখা বেশ কয়টি সমৃদ্ধ প্রবন্ধ একই মলাটের ভেতর এনেছেন। মানুষ ছাড়া ক্যামেরা মূল্যহীন। এক হিসেবে এর পেছনের মানুষটিই প্রধান। তার ভূমিকার ওপরই নির্ভর করে ক্যামেরার অভিব্যক্তি। ক্যামেরার পেছনের সেই মানুষ—মনজুর আলম বেগ কি অসাধারণ কাজ করেছেন এদেশে এর গতি দিতে, তারই এক চমকপ্রদ কাহিনী সেলিম সাবলীল ভাষায় অথচ পক্ষপাতহীনভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বর্ণনা করেছেন তাঁর জীবনীতে। বস্তুত আলােকচিত্রের ক্ষেত্রে মনজুর বিশেষ ভূমিকা না-নিলে আজ বাংলাদেশে ফটোগ্রাফির কি দশা হতাে তা কল্পনাও করা যায় না। সেই সঙ্গে মনজুরের সাফল্য ব্যর্থতা দুঃখ আনন্দ বেদনা সবকিছুই সেলিম নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন। একজন সংগঠক, একজন কুশলী আলােকচিত্রী, একজন ক্যামেরাবিশেষজ্ঞ, একজন সচেতন শিল্পী এবং একজন কৃৎকৌশলী হিসেবে মনজুরকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখে যে-ছবি তিনি বর্ণনা করেছেন তা শুধু একজন বুদ্ধিদীপ্ত রচয়িতার কাছেই পাওয়া সম্ভব। এ পরিচয় রয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডের প্রবন্ধগুলােতেও। প্রথমে মনে হতে পারে মনজুরের জীবনী প্রখম খণ্ড এবং উল্লিখিত দ্বিতীয় খণ্ড না-করে দুটি আলাদা বই করলেই বােধকরি ভালাে হতাে। কিন্তু একটু মনােযােগ দিলেই বােঝা যায় মনজুর আলম বেগের সঙ্গে এগুলাের সম্পর্ক গভীর। এদেশে আলােকচিত্রের ক্রমবিবর্তন এবং তাঁর জীবন তাে বলতে গেলে হাত ধরাধরি করে চলেছে। ফটোগ্রাফি আন্দোলনের গােড়াপত্তন মনজুরেরই হাতে। এজন্য সংগঠনও তিনিই গড়ে তােলা শুরু করেন। একতার ফল দেখানাের জন্যই হয়তাে তিনি সমবায়ীমনা ছিলেন। যে-গাছ তিনি রােপন করেন, তাঁর সৌভাগ্য-যে তিনি সেফল হাতে হাতেই পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে একদল আলােকচিত্রীর জন্ম হয়, যারা সত্যিকার অর্থে প্রফেশনাল—পেশাদার । স্বয়ং সেলিমও তাই । এ ধারা ধরেই সেলিমের প্রবন্ধগুলাে নানা বিষয় নিয়ে রচিত। প্রথমটি সমকালীন আলােকচিত্রের বিবর্তন’ বেশ বড়। এতে মােটামুটি বিস্তৃতভাবেই খ্রীস্টিয় আঠারাে শতকের মাঝামাঝি থেকে ইংরেজরা কিভাবে এদেশে ফটোগ্রাফির প্রবর্তন করে তার একটি সুন্দর ধারাবাহিক বর্ণনা রয়েছে। কোলকাতা তথা সারা ভারতে প্রথম ক্যামেরা আমদানির খবরটি এখানেই পাওয়া যায়—১৮৪০ খ্রীস্টিয় সনে। একেবারে হালের বাংলাদেশ আমল ছুঁয়েছে এ প্রবন্ধ। এ বিষয়ে জানার মত এটি একটি অতি চমৎকার প্রবন্ধ। একইসঙ্গে ফটোগ্রাফি শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি অবদান’, ‘ফটো জার্নালিজমের বিবর্তন’, ‘বিগত দেড়শ বছরে ফটোগ্রাফি বিষয়ে লেখালেখি’ এবং ফটোগ্রাফিক আন্দোলনের তিন দশক সফলতা ও ব্যর্থতা পূর্বের ধারা অনুসারেই লেখকের ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় দেয়। পাঠকও পেয়ে যান ফটোগ্রাফির বিভিন্ন বিষয়ে জানার মত উপাদান। লেখকের চমৎকার সার্থক সমালােচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘জাদুঘর, আর্কাইভ, প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা ও আলােকচিত্র’, ‘শিল্পকলা একাডেমিতে ফটোগ্রাফি’, ‘ভােটার আইডি কার্ড সমাচার’ প্রবন্ধ তিনটিতে। এগুলােতে সঠিকভাবেই তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনা ও অকর্মন্যতার বিষয়গুলাে তুলে ধরেছেন, গতানুগতিক ভাবে নয়, এদের কর্মকাণ্ড দেখিয়ে। আলােকচিত্র প্রতিযােগিতার বিচার’, ফটোগ্রাফারের সংখ্যা’-এর মত নিবন্ধেও লেখকের দৃষ্টি তির্যক কিন্তু তা সদর্থে। হক এন্ড সন্স’ সংবাদ প্রদানের মত ক্ষুদ্র প্রতিবেদন যেন। তবু বিষয়টি হারিয়ে যাচ্ছে বলে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।