আমার যখন ছয় বছর বয়েস, ‘বনের কথা’ নামের এক বইয়ে পৃথিবীর আদিম অরণ্যের চমৎকার একটি ছবি দেখেছিলাম। ছবিতে দেখানো হয়েছিল একটা অজগর সাপ আস্ত একজনকে গিলে ফেলছে। দেখতে হুবহু এই রকম বইয়ে লেখা ছিল, ‘অজগর সাপ তার শিকার না চিবিয়ে আস্ত গিলে খায়। তারপর তারা আর নড়াচড়া করতে পারে না। তাই তাদের হজমের জন্য পুরো ছয় মাস ঘুমিয়ে কাটাতে হয়।’ এ কথা জানার পর আমি জঙ্গলের এইসব দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবতে বসলাম। তারপর রংপেনসিল নিয়ে আমার প্রথম ছবিটা আঁকতে শুরু করলাম। আমার ১ নম্বর ছবি এরকম ছিল আমার এই অসাধারণ শিল্পকর্ম আমি বড়োদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের ভয় করছে কিনা। কিন্তু তারা জবাব দিলো, ‘কেন, ভয় পাবার কী আছে? টুপি দেখে আবার কেউ ভয় পায় নাকি?’ আমার ছবিটা মোটেও টুপির ছবি ছিল না। ছবিটা ছিল এক অজগর সাপের হাতি গিলে হজম করে ফেলার ছবি। কিন্তু যেহেতু বড়োরা তা ধরতেই পারলো না, তাই ওদের সুবিধার কথা ভেবে আমাকে শেষমেশ আরেকটা ছবি আঁকতে হলো আমি অজগর সাপের পেটের ভিতরটা বেশ স্পষ্ট করে এঁকে দিলাম। বড়োদের সব সময় সবকিছু খোলাখুলি ভাবে বোঝাতে হয়। আমার ২ নম্বর ছবিটি ছিল এরকম বড়োরা এবার আমাকে পরামর্শ দিলো আমি যেন অজগর সাপের ছবি, তা সে ভিতর থেকে হোক অথবা বাইরে থেকে হোক, আঁকা বাদ দিয়ে ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক আর ব্যাকরণ পড়ায় মন দিই। বাধ্য হয়ো সেই ছয় বছর বয়েসে আমি একজন দক্ষ আঁকিয়ে হবার ওই রকম চমৎকার একটা স্বপ্ন বাদ দিলাম। আমার ১ আর ২ নম্বর ছবি আঁকা কোনো কাজে আসলো না। সেই দুঃখে আমি খুব দমে গিয়েছিলাম। বড়োরা নিজে থেকে তেমন কিছু বুঝতে পারে না, আর ছোটদের পক্ষে সব সময় সবকিছু বুঝিয়ে বলা খুবই ক্লান্তিকর। সুতরাং শেষমেশ আমি অন্য কাজ বাছাই করে নিলাম; বিমান চালাতে শিখলাম। বিমান চালিয়ে আমি পৃথিবীর সব প্রান্তেই একটু-আধটু ঘুরেছি। আর এ কথা সত্যি, ভূগোল আমার খুব কাজে লেগেছে। চীন আর অ্যারিজোনার তফাত আমি বেশ চট করে ধরতে পারি। রাতে পথ হারালে এ বিদ্যা দারুণ কাজ দেয়। আমার এই জীবনে আমি বহু মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি, যারা আগামী দিনে কিসে লাভ হবে, তা নিয়ে চিন্তিত। বড়োদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি আমি। তাদের অনেক কাছ থেকে দেখে আসছি। তাই বলে তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা কিন্তু মোটেও পাল্টায়নি। বড়োদের কাউকে দেখে যদি বুদ্ধিমান বলে মনে হয়, অমনি তাকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমি আমার সঙ্গে রাখা ১ নম্বর ছবিটা বের করে দেখাই। আসলে এভাবে আমি বোঝার চেষ্টা করি লোকটা সত্যিই বুদ্ধিমান কিনা। কিন্তু মহিলা বা পুরুষ, সকলেরই এক উত্তরÑ ‘এটা একটা টুপি।’ তখন আমি আর তার সঙ্গে অজগর, আদিম অরণ্য অথবা তারা নিয়ে কথা বলি না। আমি তার স্তরে নিজেকে নামিয়ে আনি। তার সঙ্গে আমি তাস, ফুটবল, রাজনীতি অথবা রুমাল নিয়ে আলাপ করি। আর তখন সেই মানুষটা এমন একজন বিচক্ষণ লোকের পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হয়।