নিজের কণ্ঠে স্বকীয় স্বরের প্রতিষ্ঠা ক্ষণিকের আবিষ্কার মাত্র নয়, যেকোনো কবির জন্য তা এক ক্রমসাধনার পরিণতি। আত্মগত শীলনক্রিয়ার সরণিতে কবির অবিরাম পরিক্রমা। এতেই এসে ধরা দেয় ‘স্বকীয় বাণীভঙ্গিমা’। নিজের ‘বাণী’তে টেকসই ‘ভঙ্গি’ প্রতিষ্ঠার গরজে মাশরুরা লাকী একান্ত নিষ্ঠায় সক্রিয়। তাঁর কবিতার প্রথম শস্যকোষ ‘পচন ধরা বাংলা পিণ্ডে’ কবির অবচেতন দ্রোহী সত্তার পরিচয় ও প্রকাশের স্বাবলম্বিতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। সৃষ্টির দ্বিতীয় মাত্রা ‘মুক্ত করো লোহার পা’ স্তরে এসে নতুনতার আর্তিতে তিনি অধিকতর অকপট। তাঁর কবিতার পাঠবস্তু অন্তর্গত ক্ষরণে উজ্জ্বল। মুহূর্তের উত্তেজনায় আড়ষ্ট নয় তাঁর কবিতা, এর মধ্যে সক্রিয় এক প্রকার ‘মগ্ন যুক্তি’র তৎপরতা লক্ষ করা যায়। মানুষ প্রকৃতি ও সভ্যতার ত্রিমুখো তরঙ্গের মধ্যে তিনি প্রেম, ঘৃণা, বেদনা, সংহতি, ক্রোধ ও জিঘাংসার রূপায়ণে তৎপর। এছাড়া জলবায়ু, পরিবেশ, বৈশ্বিকতা, অবক্ষয় প্রভৃতি সূচকের প্রত্যয়নেও তাঁর আন্তরিকতা স্পষ্টতর। আবেগের খরস্রোত আয়ত্বে রেখে তাঁর কেবল প্রমিত বেগে পথচলা। যুক্তির সচেতন বল্গা তাঁর চিন্তায় এনে দেয় উপাদেয় সুষমতা। পৌরুষের অধিমন্যতা নারীকে যে ক্ষুদ্র গণ্ডিতে পুরে রাখতে চায়, তাকে অস্বীকার করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নারীসহায়ক এক বিকল্প এস্থেটিক্স। নিবর্তনবাদী পুরুষশক্তিকে কটাক্ষ করে তিনি ‘চামড়াসংঘ’ অভিধায় একে সনাক্ত করেন। একইসঙ্গে আক্রান্ত নারীর ‘নাভিতলের’ ‘রক্তাক্ত রায়টের’ প্রতিবাদে সম্মিলিত নারীশক্তিকে ‘লোহার পা’ মুক্ত করে প্রতিবাদের আহ্বান জানান। কবিতার রসদ তল্লাশে তাঁর নেই পৃথক যাত্রার অবকাশ; অভিজ্ঞতার মজুদ থেকেই আসে তাঁর নির্মাণের সমুদয় তেজস্বিতা। অনুভূতির ‘সততা’ আর ভাষাভঙ্গির ‘ক্ষিপ্রতা’ তাঁর শিল্পস্বভাবে অঙ্গীকৃত হতে দেখা যায়। তরুণতা-প্রসূত এক প্রকার মার্জিত দ্রোহ তাঁর কবিতায় যুক্ত করে ভিন্নতর স্বাদ, একালের কবিতায় যা একান্ত দুর্লভ।
জন্ম ১০ এপ্রিল, পাবনা শহর, নানাবাড়িতে। সম্প্রতি তাঁর কবিতা হিন্দি, নেপালি, তার্কিশ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ানো ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবিতায় অবদানের জন্য তিনি কয়েকটি সংগঠন থেকে সাহিত্য সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া তিনি একজন আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ সংখ্যা দুই। 'মুক্ত করো লোহার পা' তাঁর দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ।