ভূমিকা বাংলাবাজার পত্রিকার সঙ্গে আমার যুক্ত হওয়ার ঘটনাটি, আমার গদ্যরচনার জন্য খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। ‘আমার ছেলেবেলা’ প্রকাশিত হওয়ার সাত বছর পর, আমার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খ- ‘আমার কণ্ঠস্বর’ বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য বিভাগেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এবার, পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা ভরাট করার জন্য আমি যখন নবপর্যায়ে নির্গুণের জার্নাল লিখতে শুরু করি, তখন পর্যন্ত এই গ্রন্থটি আমার চিন্তা বা পরিকল্পনার ভিতরে ছিল না।
১৯৭৫-এর নভেম্বর নিয়ে উপসম্পাদকীয় লিখতে বসে, আমি হঠাৎই অনুভব করলাম, আমার ভিতর থেকে কী যেন উকি দিচ্ছে। এটি যে একটি পূর্ণ-গ্রন্থ, তা বুঝতে পারলাম সংশ্লিষ্ট সময় নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তিটি রচনা করার সময়। বিষয়টি যখন আমার কাছে ধরা পড়লো, তখন মনে হলো, হ্যাঁ, আমার মনের ভিতরে এই গ্রন্থ রচনা করার সঙ্গোপন প্রস্তুতি তো ছিলই। ১৯৭৫-এর নভেম্বর মাসটিকে আমি তো আমার বুকের ভিতরে গত ২১ বছর ধরে গোপন-ক্ষতের মতোই বয়ে বেড়িয়েছি। এটি অরচিত গ্রন্থ নয়। এই গ্রন্থটি আমার ভিতরে রচিত হয়েই ছিল। তাই, ডুবে-যাওয়া জাহাজ সনাক্ত হওয়ার পর, তাকে তুলে আনার কাজ সম্পন্ন করতে আমার একটুও বেগ পেতে হয়নি। ঐ ডুবে-যাওয়া জাহাজের মধ্যে দেশবাসীর বহু প্রিয়-লাশের সঙ্গে আমার নিজের লাশটিও আটকা পড়ে ছিল। তাই, মমতা সহকারেই সময়সমুদ্রের অতল-গহ্বর থেকে, আমি ঐ জাহাজটিকে উত্তোলন করেছি, যার নাম হতে পারে, ‘রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫’।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড়-ট্রাজেডিগুলোর সঙ্গে আমার কবিজীবন, অনতিক্রম্য ঘটনার আবর্তে কীভাবে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছিল, ‘রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫’-এ আমি সে-কথাই ইতিহাসের আদলে বলবার চেষ্টা করেছি। এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি আমার ব্যক্তিজীবনকে অতিক্রম করে, অনুসন্ধিৎসু ইতিহাস পাঠকের দাবিপূরণে যদি সক্ষম হয়, তাহলেই আমার শ্রম সার্থক বলে গণ্য করবো। কবিতার পরিবর্তে, সময় যে আমাকে দিয়ে আমার দেশের ইতিহাস লিখিয়ে নিচ্ছে, এ এক রহস্যজনক ঘটনাই বটে।
জন্ম: জুন ২১, ১৯৪৫, আষাঢ় ৭, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ, যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত,তিনি একজন বাংলাদেশী কবি এবং চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তাঁর কবিতায় মূলত নারীপ্রেম, শ্রেণি-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধীতা, এ-বিষয়সমূহ প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জরপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমী , ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন।