ভূমিকা ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুফি কবি জালালুদ্দীন রুমি বিশ্ব সাহিত্যের সেরা আধ্যাত্মবাদী কবি। কবিতার নিয়ন্ত্রণহীন ও সুনির্দিষ্ট প্রভাব সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধিই তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে স্থান দিয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেকে বিস্ময় বোধ করেন যে, তিনি ভাষা, মানবতা এবং মহাজাগতিক দিকগুলোকে কীভাবে এই স্বজ্ঞাত উপলব্ধি আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর নিজের সৃষ্টির গভীর ও বৈচিত্র্যময় প্রভাব তাঁর মৃত্যুর সাড়ে সাতশো বছর পরও সমগ্র বিশ্বে পাঠকদের ওপর তাঁর কবিতা রচনার কালকেও উত্তীর্ণ করেছে। এখনো তাঁর কবিতার প্রতি কবিতা প্রেমীদের আকর্ষণ আলোর প্রতি পতঙ্গের আকর্ষণের মতো। তাঁর কবিতার বিস্তৃত জগৎ, যা অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিকতার বিচারে এখনো তাঁর কবিতা সকলকে আচ্ছন্ন রাখে। মুসলিম বিশ্ব ছাড়িয়ে অমুসলিম বিশ্বেও তাঁর কবিতা ব্যাপকভাবে পঠিত কবি হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের জন্য; মানুষ, প্রাণী এবং গাছপালার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশে তাঁর বিরল ক্ষমতার কারণে; তাঁর ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধির জন্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর সাথে নিজেকে মিলিত করাকে তাঁর জীবনভর সাধনার জন্য। জালালুদ্দীন রুমির কবিতা পাশ্চাত্যে বহু শতাব্দী ধরে পঠিত হয়েছে। রালফ ওয়াল্ডো এমারসন, জর্জ উইলহেম ফ্রেডরিখ হেগেল এবং অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট লেখকের রচনায় তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাশ্চাত্যে তাঁর কবিতার জনপ্রিয়তা বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ অনুসারে, রুমি ১৯৯৭ সালে তাঁর কবিতা আমেরিকার সর্বাধিক বিক্রীত কবিতার স্থান পেয়েছিল। তাঁর জীবনী বা অন্তত তাঁর কঠোর কিন্তু অবশেষে সফল জীবনের দিকগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে পাঠকদের কাছে অনুপ্রেরণামূলক ও নৈরাশ্যের মাঝে প্রশান্তিদায়ক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। রুমির জীবনে ঘটে যাওয়া প্রধান ঘটনাগুলো অথবা যেসব ঘটনা তাঁর কবিতাকে বহুলাংশে রূপ দিয়েছে, মনে হয় যে, তাঁর ঝঞ্ঝাময় শৈশব ছিল মঙ্গোলদের হামলার সময় তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানো। তাঁর সুফি পিতা বাহা আল-দীনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক; একজন শিক্ষক হিসেবে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা; এবং বিশেষ করে তাবরিজের শামস আল-দীনের প্রতি তাঁর তীব্র আধ্যাত্মিক ভালোবাসার কারণে। পাশ্চাত্যের অনেক পাঠক রুমির কাজকে চূড়ান্ত সত্তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার নৈতিক নির্দেশক ও উৎস এবং আমাদের নিজস্ব উচ্চতর ধর্মনিরপেক্ষতার যুগকে আলোকিত করার বাহন হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও, এই শ্রেণির পাঠকরা অতীন্দ্রিয়বাদী কাজের মাঝে আনন্দ খোঁজেন এবং এ ধরনের গুণাবলির প্রতি সহজে আকৃষ্ট হন। পাশ্চাত্যে রুমির ভক্তরা তাঁকে তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বের করে এনে তাদের নিজেদের একজন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিউইয়র্কের পোশাক ডিজাইনার ডোনা করণ ১৯৯৮ সালে তাঁর ‘স্প্রিং লাইন অফ ফ্যাশন’ উন্মোচন করেন, তখন রুমি-প্রেমিক দীপক চোপড়াকে দিয়ে তাঁর পোশাকের ডিজাইনে রুমির সংগীতকে ব্যাখ্যা করার পটভূমিতে সুর বাজানোসহ তাঁর কবিতা আবৃত্তির ব্যবস্থা করেন, যা তাদের নিজস্ব সৃজনশীল অভিব্যক্তি ছিল। প্রাচ্যে এবং বিশেষ করে ইসলামি জগতের জালালুদ্দীন রুমির জনপ্রিয়তায় স্থিতাবস্থা বিরাজ করলেও পাশ্চাত্যে, বিশেষ করে আমেরিকান উদ্যোক্তারা রুমির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করার জন্য এখন প্রায় প্রতি মাসে নতুন উপায় উদ্ভাবন করছে বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি ভাগ্য জানার নতুন পদ্ধতি হিসেবে চালুকৃত ‘রুমি কার্ড’ বেশ কয়েকটি সংস্করণ আমেরিকার বড়ো বড়ো বুকস্টোরে উপস্থিত হয়েছে। রুমির জীবন ও কবিতা নিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার দিকে এক পাশে রেখেও বলা যায়, রুমিকে নিয়ে ইসলামি বিশ্ব ও পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে পার্থক্য তা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন পাশ্চাত্যের পাঠকরা রুমির কবিতার মূল প্রতিপাদ্য ‘প্রেম’ অন্বেষণ করেন। পাশ্চাত্যের পাঠকরা তাঁর রোমান্টিক চিত্রকল্পের ব্যাপক ও নিপুণ প্রয়োগে বিমোহিত, যা তাঁকে উপলব্ধি করার মধ্যযুগীয় বিচক্ষণতার ঘাটতির সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণে। অনেকে তাঁকে প্রধানত একজন ‘প্রেমের কবি হিসেবে গণ্য করেছেন। অনেকেই রুমির সুফি পরিচয় এবং তাঁর ওস্তাদ তাবরিজের শামস আল-দীনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক সম্পর্কে মুগ্ধ। রুমির কাছ থেকে শামসের রহস্যময় প্রস্থানের পর শামসের প্রতি তাঁর অপ্রতিরোধ্য আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করাকে কেউ কেউ তাদের সম্পর্ককে একটি প্রচলিত ধাঁচের প্রেমময় ব্যাপার বলে মনে করেন। ১৯৯৮ সালে সমকামী ম্যাগাজিন ‘দ্য অ্যাডভোকেট’-এ প্রকাশিত একটি লেখায় যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছিল যে ইসলামি বিদগ্ধজনেরা রুমি ও শামসের মধ্যে সম্ভাব্য সমকামী সম্পর্ককে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল বা অস্পষ্ট করতে চেয়েছেন। তবে পাশ্চাত্যের অন্যান্য পাঠকরা রুমির কবিতায় গভীর আবেগ ও যৌন মিলনের বর্ণনার উপস্থিতিতে মুগ্ধ; কারণ তারা রুমির অনেক প্রেমের কবিতায় মধ্যযুগীয় ইংলিশ কবি ও লেখক জিওফ্রে চসারের (১৩৪০-১৪০০) উপস্থিতি দেখতে পান। ইসলামি জগতের রুমি-গবেষক ও পণ্ডিতরা রুমি এবং শামসের মধ্যে সম্পর্ককে অব্যাহতভাবে সুফি ভাবধারা অনুযায়ী আল্লাহর কাছে কারো হৃদয় উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে কারো হৃদয়কে অপর একজন মানুষের কাছে উন্মুক্ত করার আহ্বানের দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। একই সময়ে, রুমি প্রিয়তমার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ককে বর্ণনা করতে প্রায়ই প্রেমে মগ্ন হওয়া, প্রেমে একাগ্র থাকা বোঝাতে অনুরূপ অর্থবোধক শব্দাবলি ও জাগতিক চিত্রকল্প উপস্থাপন করেছেন। তিনি ফারসি প্রেমের কবিতায় তাঁর সময়ে প্রচলিত রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেছেন, যেখানে কখনো কখনো পুরুষের মধ্যে প্ল্যাটোনিক প্রেম অর্থাৎ যে প্রেমে যৌন সম্পর্ক অস্তিত্বহীন বা অবদমিত, অনুরূপ প্রেমকে তুলে ধরতে যৌন চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে।