বাংলার ভেদবুদ্ধিহীন সমাজ-প্রত্যাশী মানবতাবাদী এক মহান সাধক বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম (১৯১৬-২০০৯)। আজীবন দুঃখ-দারিদ্র্যের সাথে শুধু নিজের জন্যেই নয়, সমাজের নিপীড়িত-নির্যাতিত প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ধর্মীয় বেড়াজাল ছিন্ন করতে সংশপ্তকের মতো সংগীতাস্ত্রের মাধ্যমে লড়াই করেছেন। পূর্বসূরি মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির মতো তাঁর গানের দর্শনেও আমরা দেখতে পাই মানুষের ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ সার্বজনীন ধর্মচেতনা, মানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিকতা। তিনি তাঁর জীবনাচার ও সংগীত সাধনায় ধর্মের সাহিত্য বা সংস্কৃতির প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে সকল ধর্মের অভিন্ন দর্শনের প্রতি মনোনিবেশ করে হয়ে উঠেছিলেন অবশ্য উচ্চারিত নাম। শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গান- ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটু গান গাইতাম/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ গানের এই অন্তরায় যেমন সার্বজনীন ধর্মচেতনার কথা উচ্চারিত হয়েছে, অন্য অন্তরায় তেমনই মানবতার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে - ‘বিবাদ ঘটিলে পঞ্চায়েতের বলে/গরিব কাঙ্গালে বিচার পাইতাম।’ ভাটি বাংলার এ মহান পুরুষ বাউল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হয়ে বাংলা লোকসংগীত ভান্ডারকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ ও প্রগতিশীল মনোভাবের সংগীত রচনা ও পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি গণসংগীতের এক নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে সুধীজনেরা মনে করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লন্ডনের হিবার্টে এক বক্তৃতায় এবং ১৯২৬ সালে ভারতীয় দর্শন মহাসভায় বাউল গানের মানবমুক্তির এই মহাদর্শনের কথা সগৌরবে উল্লেখ করেছিলেন। বাউল দর্শনে প্রভাবিত হয়ে কবিগুরু হয়েছিলেন রবীন্দ্রবাউল আর নজরুল হয়েছিলেন খ্যাপাবাউল। সেই বাউল দর্শনের যথাযথ বিশ্বায়ন ঘটাতে পারলে একটি সার্বজনীন, মানবিক ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠন করা সম্ভব। শাহ আবদুল করিম দৃঢ়তার সাথে বলতেন ‘একদিন এই পৃথিবীটা হবে বাউলদের।’ বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশনের সহযোগিতায় প্রকাশিত ‘শাহ্ আবদুল করিম : জীবন ও সংগীতসমগ্র’ গ্রন্থটি বাউল সমাজ ও দর্শনের প্রচার-প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।