অতি-আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য। রচনার অজস্রতা ও অভিনব লিখনভঙ্গি- এই দুই দিক দিয়াই তাঁহারা খ্যাতি ও বৈশিষ্ট্য অর্জনের অধিকারী। পুরাতনের সীমা-রেখা ভাঙিয়া-চুরিয়া উপন্যাসকে নূতন আকার দেওয়া ও নূতন পথে পরিচালিত করার কৃতিত্ব হাঁহারা দাবি করিতে পারেন। পরিকল্পনা ও রচনাভঙ্গির মৌলিকতা ইঁহাদিগকে পূর্ববর্তী ঔপন্যাসিকদের প্রভাব হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র হইতে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত উপন্যাস-সাহিত্য-বিবর্তনের যে প্রধান ধারা প্রবাহিত হইয়াছে, ইঁহারা সেই স্রোতের সহিত না মিশিয়া শাখাপথে পাড়ি জমাইয়াছেন। অবশ্য এই শাখাপথে স্রোতোবেগ স্থায়ী হইবে অথবা মূলধারা হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য ইহার রসপ্রবাহ অল্প দিনেই শীর্ণ ও শুষ্ক হইয়া পড়িবে, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। তবে ইহা নিশ্চিত যে, ইঁহারা উপন্যাসের ভবিষ্যৎ পরিণতির নূতন সম্ভাবনা জাগাইয়া তুলিয়াছেন। ইঁহাদের উপন্যাসের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, ইঁহারা খুব ব্যাপক ও গভীরভাবে গীতিকাব্য-ধর্মী। অবশ্য উপন্যাসের মধ্যে গীতিকাব্যের উন্মাদনা ও ঝংকার মোটেই নূতন উপস্থিতি বলিয়া মনে করা যাইতে পারে না। বঙ্কিমের অনেক উপন্যাসই গীতিকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভা কেবল যে কবিতার অফুরন্ত নির্ঝরে উৎসারিত হইয়াছে তাহা নহে, গদ্যের কারুকার্যখচিত পাত্রকেও ভরিয়া তুলিয়াছে; তিনি এক ছত্র কবিতা না লিখিলেও তাঁহার উপন্যাসের প্রকৃতিবর্ণনা ও চিত্তবিশ্লেষণ তাঁহার কবিত্বশক্তির অবিসংবাদিত প্রমাণস্বরূপ দাঁড় করানো যাইত। শরৎচন্দ্র সাধ্যমতো কবিত্ব-উচ্ছ্বাস বর্জন করিলেও অসতর্ক মুহূর্তে তাঁহার অন্তর্লীণ কাব্যবীণায় ঝংকার দিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু অচিন্ত্য-বুদ্ধদেবের কবিত্ব উপন্যাসের মধ্যে সর্বব্যাপী; তাঁহাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণপ্রণালী একান্তভাবে কাব্যধর্মী। তাঁহারা উপন্যাসে যে সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত ও মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেন তাহাতে মনস্তত্ত্ববিশ্লেষণের পরিবর্তে কাব্যোচ্ছ্বাসেরই প্রাধান্য। মনস্তত্ত্ববিশ্লেষণ যেন কাব্যের সোনালী কাপড়ের সীমান্তে একটু ছোটো পাড়; কবিতার তরঙ্গিত উচ্ছ্বাসকে ধরিয়া রাখিবার জন্য একটু উচ্চ তটভূমি মাত্র। জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলিকে দেখিবার ভঙ্গি, জীবন-সমালোচনার প্রণালী
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।