বাংলার সারস্বত সমাজের অজ্ঞাতে কবি সুলা গাইন নেত্রকোনার সত্রশির গ্রামে বিচরণ করেন। তিনি মধ্যযুগের শেষ ভাগের মানুষ। রামায়ণের রচয়িত্রী কবি চন্দ্রাবতী ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সেই হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কিংবা কৃষ্ণলীলার কবি সুলা গাইন বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় মহিলা কবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কোনো মহিলা কবির নাম পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান সূত্রে অনুমান করা যায় তিনি মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ ১৭৮০ থেকে ১৮৬০ এই সময়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিজের রচিত কৃষ্ণলীলা পরিবেশন করতেন। তিনি লেখাপড়া জানতেন। কবি বিজয় নারায়ণ আচার্য্য মনে করেন, কবি নিজ হাতে নিজের রচিত কাব্যের পান্ডুলিপিও প্রস্তুত করেছিলেন। রচনা করেছিলেন হাওরাঞ্চলের জনপ্রিয় মঙ্গলগান 'পদ্মাপুরাণ'। তিনি কৃষ্ণলীলার একটা গানের দল করেছিলেন। কবি মাত্রই তখন গায়েন ছিলেন। গান রচনা করে কবিরা সেই গান আসরে পরিবেশন করতেন । গানের দল নিয়ে ঘুরে ঘুরে কবি সুলা গাইন কৃষ্ণকীর্তন পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কবি কৃষ্ণকীর্তন এর 'বন্দনা গান', 'শ্রীকৃষ্ণের জন্ম', 'বাল্যলীলা', 'পতুনা বধ', 'গোষ্ঠলীলা', 'গোপাল বন্ধন', 'যশোদার খেদ' প্রভৃতি বিষয়ে পদ রচনা করেছিলেন। তাঁর গানের দলের একজন পৌঢ় বৈষ্ণবী যৌবনে সুলার দলের গায়িকা ছিল। এই বৈষ্ণবীর নাম রায়মনি। বিজয় নারায়ণ আচার্য্য রায়মনি থেকে সুলার রচিত কৃষ্ণলীলা পালার তিনটি পর্ব অনুলিখন করেছিলেন। তিনি কবির হাতে লেখা পান্ডুলিপির অনুসন্ধানও করেছিলেন। কিন্তু পাননি। ডক্টর সুকুমার সেন, 'বলেছেন কৃষ্ণলীলা পদাবলী গানের উৎপত্তি সম্ভবত নারী-সঙ্গীতে।' মূলত চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবীয় দর্শনের ধারায় এই অঞ্চলে কৃষ্ণলীলার গান বা কৃষ্ণকীর্তন গাওয়া শুরু হয়। হরিনাম বা কৃষ্ণনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে সহজিয়া মত ও পথের যে ধারা তৈরি হয়েছিল কবি সুলা গাইন তারই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কথা বলতে হলে প্রথমে মহাকবি জয়দেবের কথা বলতে হয়। জয়দেবের গীতগোবিন্দেও সংগীত ও আখ্যান আছে। জয়দেব নিজেও গান জানতেন। কৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ধারায় নেত্রকোনার সত্রশির গ্রামের কবি সুলা গাইনও চৈতন্যোত্তর বাংলায় জয়দেবের উত্তরাধিকারী।