"হাঙর নদী গ্রেনেড" বইয়ের সংক্ষিপ্ত পটভূমি: হলদিগাঁ গ্রামের এক দুরন্ত কিশোরী বুড়ি। কৈশোর থেকে সে চঞ্চলতায় উচ্ছল, কৌতূহলপ্রবণ, উৎসুক দৃষ্টি, নিবিড়ভাবে দেখা, চমৎকারভাবে মেশা, উচ্ছলতায় ভরপুর। কম বয়সেই বিয়ে হয় তার থেকে বয়সে অনেক বড় বিপত্নীক গফুরের সঙ্গে। গফুরের সংসারে তার আগের স্ত্রীর রেখে যাওয়া সলীম ও কলীম নামে দুটো ছেলে আছে। সংসারজীবন ভালই লাগে বুড়ির। যদিও গফুর বুঝতে পারে না বুড়িকে। আগের বউ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কখন কী বলে, কী করে তা বুঝা তার পক্ষে কষ্টসাধ্য। অবশ্য কারও সাথে পাছে নেই, কাউকে মন্দ বলে না, কেউ বললে ভ্রুক্ষেপ করে না। এরই মধ্যে মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে বুড়ির। সলীম-কলীম থাকলেও তার নিজের গর্ভের সন্তান চায়। অবশেষে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী রইস। তাতেও ভালোবাসা কমতি হয় না। কিছুদিন পর গফুর মারা যায়। সলীমের বিয়ে হয় রামিজার সাথে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার কোলজুড়ে আসে একটি সন্তান। কলীমের বিয়ের কথার সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বন্ধ হয়ে যায় সব আলোচনা। যুদ্ধের ঢেউ আসে হলদিগাঁয়ে। সেই ঢেউয়ে উথালপাথাল হয়ে যায় বুড়ির সাজানো সংসার। সলীম যায় যুদ্ধে। ভাই সলীম ও মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খবর না দেওয়ায় কলীমকে পাকিস্তানি আর্মি ও তার দোসররা বুড়ির চোখের সামনে নির্মমভাবে খুন করে। যা দেখে বুড়ি বলে: ‘কলীম, তোর ঘাড়টা ঝুলে পড়েছে কেন? তুই একবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকা। সাহসী বারুদ জ্বালা, দৃষ্টি ছড়িয়ে দে হলদীগাঁয়ের বুকে। মুছে যাক মহামারী, বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ। হলদীগাঁয়ের মাটি নতুন পলিমাটিতে ভরে উঠুক।’ কিন্তু পলি ভরার আগে হলদিগাঁয়ের মাটিতে রচিত হয় মর্মন্তুদ এক দৃশ্য। যে দৃশ্যের রচনাকার একজন মা। বুড়ি যার নাম। হাফেজ ও কাদের দুই মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে শত্রুপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে আশ্রয় নেয় বুড়ির ঘরে। পাকসেনারাও বাড়িতে আসে। দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় একজন মা, মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে তার নিজের সন্তানকে তুলে দেয় পাকসেনাদের বন্দুকের নলের মুখে। সন্তানের নাম রইস। মায়ের নাম বুড়ি। যার প্রতীতি এ রকম: ‘ওরা এখন হাজার হাজার কলীমের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ওরা হলদীগাঁর স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে লড়ছে। ওরা আচমকা ফেটে যাওয়া শিমুলের উজ্জ্বল ধবধবে তুলো। বুড়ি এখন ইচ্ছে করলেই শুধু রইসের মা হতে পারে না। বুড়ি এখন শুধু রইসের একলার মা নয়।’ হাঙর নদী গ্রেনেড তখন মহাকাব্যের আখ্যান হয়ে ওঠে। বুড়ি হয়ে যায় ইতিহাস-কন্যা। আর হলদিগাঁ, বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।