পোল্যান্ডের উত্তরে বাল্টিক সমুদ্র। সমুদ্র সৈকত ধরে পোল্যান্ডের সমুদ্ররেখা সাতশ-সত্তর কিলোমিটার। এই সমুদ্ররেখা ঘেঁষে বেশ কয়েকটি শহর ও বন্দর গড়ে উঠেছে। কোনোটি সমুদ্র বন্দর, কোনোটি নগর জনপদ, কোনোটি শৈল নিবাস, কোনোটি পর্যটনস্থল। শহর ও বন্দরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও নান্দনিক গিদাইন্সক। এইটি সমগ্র পোল্যান্ডের চতুর্থ বৃহৎ শহর এবং প্রধান সমুদ্র বন্দর। গিদাইন্সক থেকে বারো কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত সপোত। বাল্টিক সমুদ্রতীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈলনিবাস। ইউরোপীয়রা এই শহরকে বলে স্পা-শহর। সপোত শহরে এক খণ্ড জমির মালিকানার জন্য বিত্তবানরা পয়সা ঢালতে কার্পণ্য করেন না কেবল এজন্য না যে সেখানে ছুটি কাটানো খুব উপভোগ্য বা বিনিয়োগ করা খুব লাভজনক, বরং সপোতে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট থাকা ইউরোপীয়দের কাছে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। গৌরব, ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য্যের পাশাপাশি পোল্যান্ডের বাল্টিক সমুদ্রতীর আরো অনেক কারণে কৌতূহল উদ্রেককারী। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী কিলিং মিশন পরিচালনা করেছে। জঙ্গলের ভেতর স্থাপন করেছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। বন্দিদের সেখানে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে, নির্যাতনে বা অনাহার ও অতিশ্রমে বন্দিদের হত্যা করে নাৎসিরা ক্ষান্ত হয়নি, কাউকে কাউকে গুলির ভয় দেখিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে বিলীন করা হয়েছে। ভিন্ন এক জঙ্গলের ভেতর কিছু কিছু পাথরখণ্ডকে স্থানীয়রা রহস্যময় পাথর বলে মনে করে। বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা না, চারশ বছর ধরে ওইসব পাথরখণ্ডকে কেউ কেউ সমীহ করে আসছে। কাছাকাছি একটা বাড়ি উলটানো অবস্থায় স্থাপন করা হয়েছে। কমিউনিস্ট পোল্যান্ডের প্রতীক এই বাড়ি। কেন? নির্মাতা বলেন, কমিউনিস্ট আমলে সবকিছু না কি এমন উলটোরথে চলেছে। স্পা শহর সপোতে রাসপুতিন খুব জনপ্রিয়। সমুদ্র বন্দর গিদাইন্সকের আদি শহরের রাস্তায় ফিদেল কাস্ত্রো এমনভাবে হেঁটেছেন যেন মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওই শহরে আশির দশকে লেনিন শিপইয়ার্ডে শ্রমিক ধর্মঘট থেকে শুরু হওয়া সলিডারিটি আন্দোলন এতটা জোরদার হয়ে পড়ে যে এক সময় তা কমিউনিস্ট বিশ্বব্যবস্থা ধ্বসিয়ে দেয়। তারও আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় বাল্টিক সমুদ্র তীরবর্তী এক অস্ত্র ডিপো থেকে। ২০১৫ থেকে ২০২০-পাঁচ বছর পোল্যান্ডে কাটিয়েছি। গিদাইন্সক সহ বাল্টিক সমুদ্রতীরের বেশ কয়েকটি শহরে তখন আমার পা পড়েছে। একবার দুবার না। বহুবার। কখনো পর্যটনের টানে, কখনো ইতিহাস- ঐতিহ্যের টানে। কখনো এসেছি সমুদ্রের হাওয়া খেতে, কখনো স্থানীয়দের কাছে গল্প শুনতে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মাহফুজুর রহমান ছিলেন একজন পেশাদার কূটনীতিক। তিনি পোল্যান্ড, ইউক্রেন ও মলডোভায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্থাপত্যে স্নাতক এবং অস্ট্রেলিয়ার মনাশ বিশ্ববিদ্যালয় হতে কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, হাওয়াইয়ের এশিয়া প্যাসিফিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নিরাপত্তা ও শান্তি বিষয়ে একাধিক কর্মশালা ও অনুশীলন সমাপ্ত করেছেন। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। ১৯৬১তে জন্ম নেওয়া মাহফুজুর রহমান দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পত্রিকায় এবং অনলাইন সাময়িকী ও গবেষণা সাইটে নিয়মিত লিখেন, যার মধ্যে দি নিউ এজ, বাংলাদেশ পোস্ট, প্রথম আলো অনলাইন ভার্শন, সংবাদ প্রতিদিন, জিওপলিটিকস ডট কম অন্যতম। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতি নিয়ে যেমন লিখেন, তেমন লিখছেন নন্দনতত্ত্ব ও চিত্রশিল্প নিয়ে নিবন্ধ কিংবা ভ্রমণকাহিনি, ছোটো গল্প ও কবিতা। কোনো কোনো লেখা এর মধ্যে সাপ্তাহিক ২০০০, হাল-ফ্যাশন, তর্কবাংলা, ঘুঙুর, দেশ-প্রসঙ্গ সাময়িকীতে প্রকাশিত। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে এমন বিচিত্র সব উপাদান নিয়ে আসেন যে লেখাটি বহুমাত্রায় উপভোগ্য হয়ে উঠে। তাঁর গদ্যশৈলী সহজ এবং সাবলীল। লেখার পাশাপাশি মাহফুজুর রহমান ছবি আঁকেন, আবৃতি করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা করেন। তিনি নিতোমধ্যে ওয়ারশ, এথেন্স, মেক্সিকো সিটি এবং টোকিয়োতে চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তাঁর অধিকাংশ বইয়ের পাতায় পাতায় তিনি নিজের আঁকা ছবিও জুড়ে দেন। তিনি গান, বিশেষ করে পুঁথি ও জারি গানও রচনা করেছেন। আশ্চর্য না যে তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা তাঁকে মিজ এশিয়া-প্যাসিফিক আর্থ প্রতিযোগিতা বা গুড ফুড ফেস্টিভালে বিচারকের আসনে আসীন করেছে। ছাত্রাবস্থায় তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি সংসদীয় পদ্ধতি, শাসন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা কর্মের সঙ্গে জড়িত।