লেখকের কথা: মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কি? অর্থ- বৈভব,প্রভাব প্রতিপত্তি নাকি সন্তান সন্ততি? সর্বপ্রথম আমাদেরকে সেটাই উপলব্ধি করতে হবে। মানুষ ভেদে এই উপলব্ধির ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।অনেকের মধ্যেই এই ধারণা বিদ্যমান যে অর্থ বৈভবে সমৃদ্ধ হলে প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যায় আর সন্তান সন্ততি সুখের সাগরে হাবুডুবু খাবে।একটা বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আব্দুর রহিম মুন্সী আর আব্দুল করিম মুন্সী আপন দুইভাই হলেও তাদের চিন্তা ও ধ্যান ধারণার মধ্যে ছিলো বিস্তর ফারাক।আব্দুর রহিম মুন্সী তার সন্তান সন্ততিকে সবচেয়ে বড় সম্পদ মনে করতেন।তাই তাদের চারিত্রিক গঠণে মনযোগী ছিলেন, তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে তার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছিলো।অপরদিকে আবদুল করিম মুন্সীর মূল মনযোগ ছিলো অর্থ বৈভব বৃদ্ধির দিকে, সন্তান সন্ততিকেও তিনি কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন উপার্জন বৃদ্ধির লক্ষ্যে।দিনশেষে আব্দুর রহিম মুন্সীর সন্তানেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।তার সন্তানেরা এলাকার সামাজিক কর্মকান্ডেও অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে।সন্তানদের কারণে আব্দুর রহিম মুন্সীর সন্মান বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে যা আব্দুল করিম মুন্সীর কপালে জুটেনি।তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়- সন্তান মানুষের জন্য মূল্যবান সম্পদ ও পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। সন্তানের সাফল্যের জন্য সব অভিভাবক আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এই সাফল্য একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সফল সমাজ বিনির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এর অনেক ভূমিকা রয়েছে। প্রত্যেক পিতামাতার মধ্যে একটি বিশ্বাস থাকা জরুরী সেটা হচ্ছে প্রতিটি মানুষের মাঝেই প্রতিভা আছে, নিজস্ব সৃজনশীলতা আছে।আল্লাহতালার সৃষ্টি সবচেয়ে সুন্দর এবং মহান।বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে কারো সাথে কারো মিল বা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।আল্লাহতালা একেকজনকে একেক দিয়ে মেধা দান করেছেন।প্রত্যেক অভিবাবককে এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে আমার ছেলের মধ্যে প্রতিভা আছে।এবং তার কোন বিষয়ে সবচেয়ে বেশী মেধা প্রকাশ পাচ্ছে সেটার অনুসন্ধান করতে হবে।যে অভিবাবকরা তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত আছেন তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে স্টিফেন হকিং যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে কতো বড় বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন।কাজেই সন্তানের এই সৃজনশীলতাকে বাহবা দিতে হবে পিতামাতাকেই।সকাল পিতামাতাই তার সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করবে এই বলে যে- তুমিই সেরা। টমাস আলভা এডিসনের মায়ের কাছে পাঠানো তার সন্তানের স্কুল কর্তৃপক্ষের চিঠিটা যদি তাঁর মা সঠিকটা উপস্থাপন করতো তাহলে হয়তো এডিসন এতো বড় বিজ্ঞানী হতে পারতেন না। সন্তানের মাঝে লুকায়িত সেই প্রতিভা বিকশিত করার জন্য চাই অনুশীলন। জ্ঞানচর্চা আর অনুশীলন তাদের হৃদয়কে জাগ্রত করে। মনোজগতে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন জাগাতে সহায়তা করে।সৃজনশীলতা গতানুগতিক জীবনধারার বাইরে গিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়, নতুন কিছু করতে শেখায়, যা জীবনকে আনন্দময় আর উপভোগ্য করে তোলে। দূর করে জীবনের একঘেয়েমি ভাব।নিজস্ব সৃজনশীলতা একজন মানুষকে সাধারন অবস্থান থেকে পৌঁছে দিতে পারে অনন্য উচ্চতায়।নিজের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, যত্নশীলতা আর যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে।শুধু বিশ্বাস করতে হবে- 'আমার আমি সবচেয়ে দামি' সন্তানের সাফল্যের জন্য প্রতিটা অভিবাবককে প্রথমেই জোর দিতে হবে চারিত্রিক গঠণের দিকে।সন্তানকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে।কারণ সভ্যতার প্রধান উপাদান হলো শিক্ষা। যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। কোনো জাতি ও সভ্যতার উত্থান-পতনের সঙ্গে শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষার আলোয় মানুষ অন্ধকারকে জয় করে। অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পায়। মুক্তির পথের দিশা খুঁজে পায়। আলো-আঁধার, ভালো-মন্দ, নীতিনৈতিকতা ও ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পরখ করার অন্যতম মাধ্যম হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানবপ্রাণের লুক্কায়িত পশুত্বকে অবদমিত করে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। মানুষকে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী করে তোলে। জাতীয় জীবনের অগ্রগতির মূলমন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। এ কারণেই শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। শিক্ষা যে, শুধুমাত্র একটি জাতির মেরুদণ্ড তা নয় বরং শিক্ষা মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। সুনির্দিষ্ট দর্শন ভিত্তিক শিক্ষা মানুষকে সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি কুসংস্কার অসদাচরণ হতে রক্ষা করে আলোকিত মানুষ, সমাজ ও একই সাথে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। একই সাথে জন্মগত অধিকার। শিক্ষা শুধু অধিকারই নয়, জাতি গঠনের মূল স্তম্ভও বটে। এই শিক্ষা লাভে কেউ কাউকে বাধা প্রদান করতে পারে না তেমনি শিক্ষা কেউ কেড়ে নিতেও পারে না। পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া একমাত্র বিবেচনার বিষয় হতে পারে না।আমি আমার ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে শিক্ষার সাথে জড়িত থেকে এই উপলব্ধি করেছি জিপিএ-৫ এর চেয়েও অনেক বেশী জরুরী প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করা।শুধু ভালো নাম্বার পেলেই হবে না শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরোটা বিষয়কে অনুধাবন করার পাশাপাশি আয়ত্ত করতে হবে।জগতে যারা সফল হয়েছেন তাদের সকলেই কি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করেছিলেন?যে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম মাস্টার্সের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত তিনি কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন কোন সনদ অর্জন করেননি।আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই- সর্বপ্রথম হতে হবে একজন ভালো মানুষ অতঃপর ভালো ছাত্র। আমি ভালো মানুষ হলাম কি না, আমার মধ্যে মানবিকতাবোধ, নৈতিকতাবোধ আছে কি না, আমি একজন সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠলাম কি না, আমি সুস্থ, সুন্দর মন নিয়ে বড় হচ্ছি কি না; সেটা সবার আগে বিবেচনার বিষয়। মানবিক মূল্যবোধ, নীতি আদর্শ, সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষই প্রকৃত মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টায় শিক্ষা। সন্তানকে একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই যা সন্তানের চারিত্রিক গঠণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এধরণের বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে।যেসকল বই সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, মনোবল বাড়াবে, হতাশা দূর করবে সেধরণের বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে।মহামনিষীদের জীবনী পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হব।সভ্যতা বিনির্মাণে বই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই বইটিতে মনিষীদের জীবনীর সাথে একজন মহা মানবের জীবনী আলোচনা করা হয়েছে যার স্থান অনেক উপরে তিনি হচ্ছেন বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ ( সঃ)। উনার জীবনী অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য হচ্ছে হজরত মোহাম্মদ ( সঃ) এর জীবনী পাঠ করলে এবং অনুসরণ করলে পাঠকের চারিত্রিক গঠন হবে মজবুত।কারণ মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্পর্শ করেনি। এমন কোনো অনুভূতি নেই, যা তিনি অনুভব করেননি। ব্যবহারিক, আধ্যাত্মিক, ইহলৌকিক, পারলৌকিক- সব কিছুই তার জীবন ও সাধনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ফলে তার জীবনাদর্শ সর্বকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। জীবন পথের আলোর মশাল ও দিকনির্দেশনা স্বরূপ। এই বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে আমাকে ইন্টারনেট থেকে, বিভিন্ন ব্লগ থেকে, পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে।আমার উদ্দেশ্য তরুণ সমাজ এই বইটি পাঠ করে উদ্দীপ্ত হবে এবং প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে।প্রতিটি তরুন হতাশাকে পায়ে ঠেলে জীবনপথে রেখে যাওয়া মনিষীদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে নিজেরাও সফলতার মিষ্টি স্বাদ গ্রহণ করবে।