বিদীর্ণ পরিপার্শ্বের স্বাতন্ত্র্য তৎপরতায় নাগরিক ভঙ্গির লোকায়ত ঐক্য গড়তে অব্যর্থ বয়ানে নিজেকে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যে দাঁড় করিয়েছেন আসাদ চৌধুরী। কবি নামে যাঁর ভিন্ন অথচ অনবদ্য চিত্রায়ণ প্রজন্মের খোলাপাতায় যূথীবনের ন্যায় পরানে পরান মিলিয়ে গাল-গপ্পো করে শুক্লা দ্বাদশীর সন্ধ্যায়। আবার লেখনীর সাধনার উত্তম আরাধনায় একেবারে অনেকটাই বলা চলে স্বীয় তপস্যাবলে পাঠকের মননে গদ্যের রণরণি তুলে দিয়েছেন তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে বয়ে যাওয়া মন্ত্রের মহা-ওঙ্কারধ্বনিতে। পাঠকও তাঁর গদ্যের সহজাত সারল্য, মৃদু অথচ দৃঢ় সাবলীলতাকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অমীয়সুধারূপে চুম্বন করেছে। আঁকড়ে ধরেছে পাঠসরস শব্দবন্ধের শেকড় সন্ধ্যানী আশা জাগানিয়া রতনরূপে। পাঠকের ভালোবাসায় পদ্যবীণার ঘাটে আসাদ চৌধুরীর গদ্য নেহায়েত কম নয়। যা ইতোমধ্যে গদ্যসমগ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের মলাট ছাড়িয়ে তৃতীয় খণ্ডে এসে পৌঁছিয়েছে; ভাবা যায়! কিন্তু সত্যিই, ভাবনা নয়; তাঁর গদ্যসমগ্রের তৃতীয় খণ্ডটিও দৃশ্যমান। এমনই দৃশ্যমান অদৃশ্যের ঘেরাটোপে ডুবে থাকা বাস্তবতাকে তিনি গদ্যের গাঁথুনীতে অনন্য করেছেন। যা গদ্যসমগ্রের তৃতীয় খণ্ডের মলাটের ভেতর খুঁজে পাবে পাঠক। জীর্ণ পারিজাতের অধরা আঘাত আমাদের কতটা প্রলুব্ধ করে তা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর গদ্যের নিপুন আঘাতে। যা প্রতিধ্বনিত হবে যুগের ঝলমলে বৈঠকখানায়। আর সময়ের যতনে হয়ে উঠবে ভাঁজখোলা রোদ্দুর। বাঙালি জীবনের সংস্কৃতি, আন্দোলন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা সর্বোপরি প্রতিটি সুপ্ত এবং প্রস্ফূটিত আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ, দৃঢ় ও নমনীয় তান রাজৈশ্বর্যের ন্যায় চিত্রিত হয়ে আছে আসাদ চৌধুরীর গদ্যের ধারাপাতে। তাঁর গদ্যের নম্রশিরেই তিনি বাঙালি জীবনের সুরভিত সৌরভ ছড়িয়েছেন ধিঁকিধিঁকি আলোর ছায়াতলে। সোনালি প্রভাতের আশায় এই বাংলার তপ্ত পথজুড়ে শুনিয়েছেন নূতন প্রাণের গান। যে গান ঘিরে আছে বাঙালির ইতিহাসের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকা পথফুলের ভারে দুলে ওঠা আজন্ম সরলতা। সেই সরলতায় বেঁচে থাকুক গদ্যসমগ্র তৃতীয় খণ্ডের আলোকিত ফল্গুধারা।
আসাদ চৌধুরী। জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, উলানিয়া, বরিশাল। বাংলাদেশের কবিতায় ‘তবক দেওয়া পান’ নিয়ে আসাদ চৌধুরীর আর্বিভাব। স্বল্পবাক, ঋজু এবং বক্তব্য প্রকাশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিকীর্ণ এই কবি, বাংলাদেশের ষাট দশকের কবিতায় সংযোজন করেছেন নতুন মাত্রা। এ মাত্রা লক্ষণীয় তাঁর ভাষা ও প্রকরণে; যেখানে তিনি ঐতিহ্য, শে¬ষ, প্রেম, সৌন্দর্য ও মরমি চেতনার সংমিশ্রণ ঘটান। আসাদ চৌধুরী, তাঁর কবিতায় মরমি-মানসিকতা নিয়ে বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করেছেন। আর তাই ছন্দে মেজাজে এবং বক্তব্যে তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় এক যুগ সময়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এবং জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। জার্মানির কোলনের ভয়েস অব জার্মানির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন (১৯৮৫-৮৮)। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রায় ছাব্বিশ বছর। আসাদ চৌধুরী কবিতা আবৃত্তি করেন। বেতার টিভিতে উপস্থাপনা করেন। প্রচুর নাটক সিনেমা দেখেন। ভ্রমণ তার নেশা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোতেই তার আনন্দ। সব বয়সী পাঠকের জন্য কবিতা, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিশেষভাবে ছোটদের জন্য লিখেছেন ছড়া-কবিতা, রূপকথার গল্প, অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্থও। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (২০১৩) সহ অসংখ্য পুরস্কার। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল চির তারুণ্যের প্রতীক আসাদ চৌধুরী ছোট বড় সকলেরই প্রিয় মানুুষ।