বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা। অসংখ্য ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর এই জেলা। কিছু ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আবার কিছু ইতিহাস আজও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চুয়াডাঙ্গার মানুষের অতীত গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য। এরকমই প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি ঐতিহ্যের নিদর্শন হচ্ছে “চুয়াডাঙ্গার ইমামবাড়া” যা কিনা ওই অঞ্চলের মানুষের অতি প্রিয়, ভক্তিশ্রদ্ধা ও প্রশান্তির জায়গা হিসেবে বহুকাল বিবেচিত হতো। চুয়াডাঙ্গা সদরে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্র রেল পাড়ায় অবস্থিত এটি। এই ইমামবাড়ার ইতিহাস লেখার কাজ যখন শুরু হল তখন সময়টি ২০২০ সাল। চুয়াডাঙ্গার ইমামবাড়া নিয়ে এবারই প্রথম ইতিহাস লেখা হল। চুয়াডাঙ্গায় ইমামবাড়ার ইতিহাস বর্ণনা করার আগে এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং গঠন কাঠামো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। ভৌগোলিক অবস্থান ও কাঠামো ব্রিটিশ শাসনাধীনে বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলা ছিল বৃহত্তর নদিয়া জেলার একটি উপজেলা। চুয়াডাঙ্গা জেলার পশ্চিমে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা, উত্তর-পশ্চিমে মেহেরপুর জেলা, উত্তর-পূর্বে কুষ্টিয়া জেলা এবং দক্ষিণে যশোহর ও দক্ষিণ-পূর্বে ঝিনাইদহ জেলা অবস্থিত। ইমামবাড়াটি চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের বেশ উঁচু একটি ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইমামবাড়ার একেবারে সামনেই রয়েছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা নবাব আলীবর্দী খাঁ’র অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত তৎকালীন সময়ের আঞ্চলিক জমিদারের পুরোনো বাড়ি। ধারণা করা হয় এই বাড়িটি তিন শ’ বছরের পুরোনো কিংবা তারও আগের। ওই জমিদার বাড়ি ও ইমামবাড়া একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে। মাঝখানে রয়েছে বড় উঠান আর পরিত্যক্ত বহু প্রাচীন ইন্দিরা বা ছাদযুক্ত বৃহৎ আকৃতির পানির কুয়া। এক সময় পুরো স্থাপনাগুলো দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। বের হবার জন্য উত্তর ও দক্ষিণে দু’টি দরজা ছিল। নবাব আলীবর্দী খাঁ’র অধীনস্থ এই জমিদারের অনেকগুলো ঘরের মধ্যে এখন মাত্র একটি ভাঙ্গা ঘর অবশিষ্ট আছ। তাও আবার ছাদ নেই এবং ভেতরে সাপ, পোকা-মাকড় ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ। ইমামবাড়া, ইন্দিরা ও জমিদারের বাড়ি তৈরিতে যেসব ইট ব্যবহার হয়েছে ধারণা করা হয় তা প্রায় একই সময়কার। কারণ এগুলো দেখতে একই ধরণের। ইটগুলো প্রায় এক ফুট লম্বা এবং বেশ পুরু। ২৬ ইঞ্চি চওড়া দেয়ালগুলোর গাঁথুনিতে ইটের ভাজে ভাজে চুন ও ইটের সুরকির ব্যবহার রয়েছে। মাটির কিছুটা নীচে ও উপরে এলোমেলোভাবে তিন কোনা আকৃতির অনেক ইটও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। মাথার দিকে ধনুকের মতো বাঁকা কিন্তু তিন কোনাবিশিষ্ট ত্রিভুজ আকৃতির এসব পুরু ইট ঘরে কিংবা ইমামবাড়ায় ওঠার জন্য সিঁড়ি বানানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। গোলাকৃতির সিঁড়ি বানানোর জন্যই বিশেষ আকৃতিতে তৈরি এসব ইটের মাথাকে ধনুকের মতো গোল করা হতো। যদিও ওই সিঁড়িগুলোর এখন আর কোনো ব্যবহার নেই। ইমামবাড়ার সামনেই ছাদযুক্ত ইন্দিরা (পানির কুয়া) এতবড় ছিল যে, ইন্দিরার ভেতরে নামার জন্য বিশেষ লোহার সিঁড়ি ছিল। যদিও এখন সিঁড়িগুলো নেই এবং ইন্দিরার অস্তিত্বও বিলীন হওয়ার পথে। নবাব আলীবর্দী খাঁ’র অধীনস্থ এই জমিদার বাড়ি, উঠান, ইন্দিরা ও ইমামবাড়া পুরো কমপ্লেক্সটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকলেও ইমামবাড়ার পেছনের দিকে একপাশে একটি দরজা রয়েছে যাতে করে বাইরের মেহমানরা ভেতরে এসে বসতে পারে। ইমামবাড়ার ভেতরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটি ঘর বা হুজরাখানা রয়েছে। এই ছোট্ট ঘরের প্রবেশ মুখে একসময় লাল ও নীল রঙের দু’টি পর্দা ঝোলানো থাকত। ‘লাল রঙ’ ছিল শহীদ ইমাম হোসেন (আ.)-এর রক্তের প্রতীক এবং ‘নীল রঙ’ ছিল বিষ খাওয়ার কারণে ইমাম হাসান (আ.)-এর দেহ নীল রঙ ধারণ করার প্রতীক। ওনাদের স্মরণেই এই ঘরে একসময় মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো। যদিও এখন ওই পর্দা ঝোলানো থাকে না। বর্তমানে এই ছোট্ট ঘর তৈরির ব্যাপারে দ্বিতীয় ব্যাখ্যা দেয়া হয়। দাবি করা হয়, এটি কাদেরি তরিকার পীরের প্রথম আগমনের পদধূলির স্থান বা স্মৃতিচিহ্ন। যদিও পরে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি মোটেই সঠিক নয়। ইমামবাড়ার পেছনে রয়েছে একটি খালি জায়গা এবং আরো পেছনে আছে একটি পুকুর। সবমিলিয়ে ইমামবাড়ার পেছনে রয়েছে বিশাল জায়গা। তবে পুকুরের পাশেই ছিল আরেকটি ভবন বা বৈঠকখানা যেখানে বসে সর্বশেষ স্থানীয় জমিদার গোলাম রশীদ জোয়ার্দ্দার তার প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করতেন। ওই ভবনেরও এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বংশপরম্পরায় তারা নবাবি আমলে এবং পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলেও খাজনা আদায় করতেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর যেসব জমিদার ইংরেজদের বিরোধিতা করার কারণে জমিদারি হারিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চুয়াডাঙ্গার এই জমিদার। যদিও ইংরেজরা খাজনা আদায়ের স্বার্থে এই পরিবারের কাছে তাদের জমিদারি আবারো ফিরিয়ে দিয়েছিল। ইমামবাড়া নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। গত প্রায় দেড় শ’ বছর আগের ইতিহাস, নিকট অতীত এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী। ধারণা করা হয় সেই আমলে জনসংখ্যা ছিল কম। তাই ইমামবাড়া তৈরির সময় প্রচুর জায়গা থাকলেও এটি ছোট আকারে তৈরি করা হয়েছিল। ইমামবাড়াটি ঠিক কবে তৈরি করা হয়েছিল কিংবা কে প্রথম তৈরি করেছিলেন তা নিয়ে সঠিক ইতিহাস লিখিত আকারে কোথাও নেই। শতাধিক বছর ধরে জোয়ার্দ্দাররা পারিবারিকভাবে এটি পরিচালনা করে আসছে। বংশপরম্পরায় মুখে মুখে বলা কথাগুলোই এখন ইতিহাস হয়ে আছে। চর্চা না থাকায়, গুরুত্ব¡ না দেয়ায় অথবা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বহু কথা ও স্মৃতি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আবার কিছু বিষয় টিকে আছে।