এইবার আগে জয়ন্ত আর মানিকলালের একটুখানি পরিচয় দেওয়া দরকার। জয়ন্তের বয়স একুশ-বাইশের বেশি হবে না, তবে তার লম্বা- চওড়া চেহারার জন্যে বয়সের চাইতে তাকে অনেক বেশি বড় দেখায়। তার মতন দীর্ঘদেহী যুবক বাঙালি জাতির ভিতরে বড় একটা দেখা যায় না, তার মাথার উচ্চতা ছয় ফুট চার ইঞ্চি। ভিড়ের ভিতরেও সে নিজেকে লুকোতে পারত না, সকলের মাথার উপরে জেগে থাকত তার মাথাই। রীতিমতো ডন-বৈঠক, কুস্তি, জিমনাস্টিক করে নিজের দেহখানিকেও সে তৈরি করে তুলেছিল! বাঙালিদের ভিতরে সে একজন নিপুণ মুষ্টিযোদ্ধা বলে বিখ্যাত। আপাতত এক জাপানি মল্লের কাছ থেকে যুযুৎসুর কৌশল শিক্ষা করছে। মানিকলাল বয়সে জয়ন্তের চেয়ে বছর দুই-এক ছোট হবে। নিয়মিত ব্যায়ামাদির দ্বারা যদিও তারও দেহ খুব বলিষ্ঠ, কিন্তু তার আকার সাধারণ বাঙালিরই মতন, ইচ্ছে করলেই সে আর পাঁচজনের ভিতরে গিয়ে অনায়াসেই আপনাকে লুকিয়ে ফেলতে পারত। জয়ন্ত ও মানিকলাল দুজনেই এক কলেজে পড়াশুনা করত, কিন্তু 'নন-কো-অপারেশন' আন্দোলনের ফলে তারা দুজনেই কলেজি পড়াশুনো ত্যাগ করেছিল। তারা দুজনেই মাতা-পিতৃহীন, কাজেই স্বাধীন। দুজনেরই কিছু-কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে, কাজেই তাদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ও নেই। ছেলেবেলা থেকেই তাদের ভারি শখ, বিলাতী ডিটেকটিভের গল্প পড়বার। এসব গল্প তারা একসঙ্গে বসেই পড়ত এবং গল্প শেষ হলে তাদের ভিতরে উত্তপ্ত আলোচনা চলত! এডগার অ্যালেন পো, গে-বোরিও, কন্যান ডয়েল ও মরিস লেবলাঙ্ক প্রভৃতি বিখ্যাত লেখকদের কাহিনী তো তারা একরকম হজম করেই ফেলেছিল এবং হাতে সময় থাকলে অবিখ্যাত লেখকদেরও রচনাকে তারা অবহেলা করতে পারত না। কিন্তু তাদের কাছে উপাস্য দেবতার মতন ছিলেন কন্যান ডয়েল সাহেবের দ্বারা সুপরিচিত ডিটেকটিভ শার্লক হোমস। একটি বোতাম, এক টুকরো কাগজ বা একটা ভাঙা চুরোটের পাইপের মতন তুচ্ছ জিনিস দেখে শার্লক হোমস বড় বড় চুরির বা খুনের আসামীকে ধরে ফেলতে পারতেন, জয়ন্ত ও মানিকলাল রুদ্ধশ্বাসে তাঁর সেই বাহাদুরির কথা পাঠ করত এবং বসে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্নে দেখত, তারাও যেন গোয়েন্দা হয়ে শার্লক হোমসের মতন তুচ্ছ সূত্র ধরে বড় বড় চুরি-রাহাজানি-খুনের কিনারা করে ফেলে লোকের চোখে তাগ লাগিয়ে দিচ্ছে!
জন্ম ১৮৮৮, কলকাতা। সাহিত্যচর্চার শুরু মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। খেয়ালি জীবন, ঘুরে বেড়িয়েছেন সাহিত্য সংস্কৃতির নানান স্রোতে। ‘ভারতী’ গােষ্ঠীর সাহিত্যিক হিসেবেই প্রথম পরিচয়। ‘বসুধা’ পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। বহু গান লিখেছেন, নাচ শেখাতেন, নাটকও লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন নাটক বিষয়ক সাময়িকপত্র ‘নাচঘর’। পরবর্তী সময়ে সম্পাদক ছিলেন ছােটদের বিখ্যাত পত্রিকা রংমশাল-এরও। কিশাের সাহিত্যের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। লিখেছেন অজস্র বই। বয়স্ক পাঠকদের জন্য কাব্য-অনুবাদে ‘ওমর খৈয়ামের রুবায়ত’ বা ছােটদের জন্য ‘যকের ধন, ‘দেড়শাে খােকার কাণ্ড’, ‘ঝড়ের যাত্রী’, ‘কিং কং’ সমান আদৃত। বিখ্যাত প্রবন্ধের বই ‘বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার। জীবনাবসান ১৮ এপ্রিল ১৯৬৩।