বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে মুহম্মদ নূরুল হুদা কবি হিসেবে নিজের নাম এমনভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন; তা তার কাব্যের নামকরণ থেকে বুঝা যায়। কবিতার বইয়ের নাম ‘আমরা তামাটে জাতি’ চিত্রকল্প থেকেই অনুধাবন করা যায় তার মনোজগত কোথায় গিয়ে তোলপাড় তুলেছে। একটি জাতির আইডেন্টিটি শনাক্ত করে তাঁর যাপনের শক্তিকে কাব্যের পঙ্ক্তিভুক্ত করেছেন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঘামশ্রমশোষণশাসন আর জারিত উদ্ভাবন, মেধা, যাপন, কৃষ্ঠির আলোড়নকে তিনি তোলে ধরেছেন অনুভবের উদ্ভাসনে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- একটি জাতির হাজার বছরের যাপিত জীবনের আইডেন্টিটিকে শনাক্ত করা। এ অনুভবের শক্তি তিনি কোথায় পেলেন ভাবতে অবাক লাগে। বঙ্গোপসাগরের তীরের দিগন্তের খোঁসা ভেঙ্গে তিনি নির্মাণ করেছেন নিজের কাব্যদিগন্ত। এ এক মহাজাগতিক সংবেদন। বাঙালির ভাবসম্পদের অর্জন হিসেবে ‘আমরা তামাটে জাতি’ চর্যাপদের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চর্যাপদে এ জাতির শুধু মনোজাগতিক আলোড়ন, জনসমষ্টির দুঃখীযাপনই ধরা পড়েছে। বাঙালির বীরত্বের যে দাঢ্য লড়াই সংগ্রাম তা ধরা পড়েনি। এদিক থেকে চর্যাপদে আমাদের জন্য কিছুটা ঘাটতি থেকেই গেছে। যে ঘাটতি পূরণ হলো ‘আমরা তামাটে জাতি’ কাব্যে। এখানে বাঙালির হাজার বছরের লড়াই সংগ্রাম, লোকজীবন, লোকৃষ্টি, শ্রমঘন জীবনের শক্তি এমনভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে তা অতুলণীয়। বাঙালি জাতিসত্তাসহ তার সংগ্রামকে বুঝতে ‘ আমারা তামাটে জাতি’ বইটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখতে হবে। বাঙালির সংবেদনের শক্তিকে বুঝতে হলে এছাড়া কোন উপায় নেই। তাই এডুসেন্ট্রিক প্রকাশ এটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে। বইটি না পড়লে একটি জাতির জন্মের যে সংগ্রাম তা বুজতে পারবেন না। তাই বইট অবশ্যই পাঠ্য, কিনতে হবে।
মুহম্মদ নূরুল হুদা ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ সেকান্দর ও মাতা আঞ্জুমান আরা বেগম। মূলত কবি তিনি। তবে কথাসাহিত্য, মননশীল প্রবন্ধ ও অনুবাদসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি বিচরণশীল। অতিপ্রজ ও সব্যসাচী এই লেখকের স্বরচিত, অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), যশোর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল হাসান কবিতা পুরস্কার (১৯৮৩), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কক্সবাজার পদক (১৯৮৯), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৪), আহসান হাবীব কবিতা পুরস্কার (১৯৯৫), যুক্তরাষ্ট্রের আই.এস.সি ঘোষিত পয়েট অব ইন্টারন্যাশনাল মেরিট ও পয়েট অব দ্য ইয়ার (১৯৯৫), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ কর্তৃক প্রদত্ত নজরুল জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা (১৯৯৯), জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা (১৯৯৯), সুকান্ত পুরস্কার (২০০৪), একুশ-উনিশে ভাষা গৌরব শীর্ষক ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সম্মাননা (২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১২) ইত্যাদি। ১৯৯৭ সালে তিনি তুরস্কের রাষ্ট্রপতি সুলেমান ডেমিরিল কর্তৃক বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা দিয়ে। তারপর বাংলা একাডেমিতে চাকরি বদল। এখানেই বিকশিত তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সময়। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সদস্য-সচিব। বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের লেখকদের সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি। তিনি আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রবক্তা। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি সাহিত্য-সংগঠক হিসেবেও তিনি সর্বমহলে সমাদৃত।