পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অপার রহস্যের এক লীলাভূমি। সুন্দরবন এবং বনসংলগ্ন জনপদের জীবনযাত্রা নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। জীবিকার সংস্থানে এ অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পেশাকে বেছে নিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে মৌয়াল, জেলে, বাওয়ালী, কাঁকড়া শিকারী, রেনু-শিকারী, দস্যুবৃত্তি ছাড়াও অন্যান্য বনজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। সুন্দরবনের মানুষ নানারকম বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা-অর্চনা করে থাকে। এসব পূজা-অর্চনার মাধ্যমে তাদের ধ্যান-ধারণা, সংস্কার-বিশ্বাস তথা সাংস্কৃতিক জীবনেরও পরিচয় ফুটে ওঠে। এসব দেবদেবীর পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে এখানকার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও তৈরি হয়। সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন বিচিত্র শ্রেণিপেশার মানুষের জীবন-সংগ্রাম, আচার-ব্যবহার, প্রথা-পদ্ধতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে বিধৃত হয়েছে। সাহিত্যের পাশাপাশি নাটক, সিনেমা ও অন্যান্য গণমাধ্যমেও এদের জীবন ও সংস্কৃতি নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এসব মাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, সমষ্টিচেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সুন্দরবনের লোকজীবনের বিশেষত্ব এবং এই মানসিকতার প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে এখানকার লোকসংস্কৃতি। বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-গীতিকার সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য, রহস্যলীলা, লোকসংস্কৃতি অবলম্বনে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। আর এসব সাহিত্যকর্মে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রহস্যলীলা ছাড়াও এখানকার জনজীবনের নানামাত্রিক রূপ, সংস্কার, প্রথা-পদ্ধতি, মিথ বিচিত্ররূপে ফুটে উঠেছে। কিন্তু এসব নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার তেমন দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। তাই ‘বাংলা সাহিত্যে সুন্দরবনের সমাজ-সংস্কৃতি’ শীর্ষক গবেষণাপ্রকল্পের আওতায় ক্ষেত্রসমীক্ষা, জরিপ, কেস স্টাডি, সাক্ষাৎকার পদ্ধতির মাধ্যমে সুন্দরবনের সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি পাঠবিশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমে সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন মানুষের জীবনযাত্রা অবলম্বনে রচিত সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত সুন্দরবনের জীবন ও সংস্কৃতির পরিচয় উপস্থাপন করা হয়েছে। এ গবেষণায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা ও গবেষণার নানা সমস্যা স্পষ্টরূপে তুলে ধরা হয়েছে এবং প্রতীয়মান সমস্যাসমূহের সম্ভাব্য সমাধানের পরামর্শও লিপিবদ্ধ হয়েছে। সর্বোপরি ‘বাংলা সাহিত্যে সুন্দরবন: সমাজ-সংস্কৃতি’ শীর্ষক এ গবেষণা-অভিসন্দর্ভটি বাংলাদেশে সুন্দরবনের সাহিত্যগবেষণার ক্ষেত্রে একটি আস্থাযোগ্য মানদণ্ড হয়ে উঠেছে।