কবিতার সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ এক চিরকালীনতায় বাধা। কবিতার কেন্দ্রোৎস আবেগ। আর নারী ও পুরুষের প্রেমের আবেগের মতো আতীব্রতা আছে কোথায়? তাই আদিপ্রেমের সঙ্গে আদি কবিতা জড়িত। প্রেমের গভীরতলে রয়েছে যৌনতা; কিন্তু যখন ‘প্রেম’ হয়ে ওঠে তখন যৌনতাকে সে ছাড়িয়ে যায়। যৌনতা প্রেম নয় ;—কিন্তু শারীরিকতাকে একেবারে ছাড়িয়েও কি প্রেম হয়? আমরা বরং বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করতে পারি : প্রেমের এক মেরু যদি শারীরিকতায় তো আর-এক মেরু আধ্যাত্মিকতায়। হিব্রু আর ফারসি কবিতা থেকে বিশাল প্রেমের জগতের এই দুই মেরু ছুঁয়ে আসা যাক : জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) জীবদ্দশায় তার সাতটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো : “ঝরা পালক” (১৯২৭), “ধূসর পাণ্ডুলিপি” (১৯৩৬), “বনলতা সেন (১৯৪২, কবিতাভবন-সংস্করণ), “মহাপৃথিবী” (১৯৪৪), “সাতটি তারার তিমির” (১৯৪৮), “বনলতা সেন” (১৯৫২, সিগনেট প্রেস-সংস্করণ) ও “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৫৪)। এই সাতটি কবিতাগ্রন্থে কবির ১৬২টি কবিতা সংকলিত হয়েছিলো। ১৯৭৪ শালে কবির একটি অগ্রন্থিত কবিতা-সঞ্চিতার ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম, এ পর্যন্ত সর্বমোট কবির প্রায় চারশো কবিতার সন্ধান পাওয়া গেছে। (“জীবনানন্দ দাশের কবিতা”, ১৯৭৪, নলেজ হোম) আরো ২০-বছর পরে, কবির মৃত্যুর ৪০বছর পরে, প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের “প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র” (১৯৯৪, অবসর)। এই গ্রন্থে কবির ৬০০ কবিতা সংকলিত হয়েছে। এই সগ্রহের ভূমিকায় আমি পরিষ্কার বলেছি, এই গ্রন্থ সেরকমই সমগ্ৰতাকাঙ্ক্ষী একটি প্রয়াস—যদিও আমি একে সম্পূর্ণতার দিকে একটি পদক্ষেপ মাত্র বলতে চাই ;—কেননা কবির লেখা আরো কবিতা পত্রপত্রিকা ও পাণ্ডুলিপি থেকে আবিষ্কৃত হতে পারে বলে আমার ধারণা। কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ (১৯৩১-৯৫) বর্তমান সংকলয়িতাকে জানিয়েছিলেন বছর বারো আগে, তিনি একবার ট্রেনে কবির কিছু পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফ্যালেন। স্বয়ং কবি তার শেষ-জীবনের বন্ধু ও নিত্যসহচর সুবোধ রায়কে বলেছিলেন, “আমার বহু কবিতা, প্রায় শ'তিনেক নষ্ট হয়েছে, উইয়ে কেটেছে বরিশালে। অনেক বই, বহু মূল্যবান চিঠিও উদ্ধার করতে পারিনি। মনে পড়লে কষ্ট হয় খুব।' কবির প্রেমের কবিতার এই সমগ্র সংগ্রহ সম্পাদনা করতে গিয়ে এসব কথা আমরা মনে রেখেছি। কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে “বনলতা সেন” (১৯৫২, সিগনেট প্রেসসংস্করণ) কে আমরা মূলত প্রেমকবিতার বই হিশেবে বিবেচনা করতে পারি। কবির মৃত্যুর পরে অগ্রন্থিত কবিতার যে-সব সংকলন বেরিয়েছে তার মধ্যে গোপালচন্দ্র রায়-সম্পাদিত “সুদর্শনা (১৯৭৩, সাহিত্য সদন) কে প্রেমের কবিতাগ্রন্থ হিশেবে চিহ্নিত করা যায়। সম্পাদক লিখেছেন, ‘... সংগৃহীত কবিতাগুলি থেকে বেছে ৪০টি প্রেমের কবিতা নিয়ে জীবনানন্দের অগ্রন্থভুক্ত প্রেমের কবিতার এই সংকলনগ্রন্থটি করলাম।’
জন্ম-(ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৮৯৯ - বঙ্গাব্দ ফাল্গুন ৬, ১৩০৫ - কার্তিক ৫, ১৩৬১) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। তাকে বাংলাভাষার "শুদ্ধতম কবি" বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি (অক্টোবর ২২, ১৯৫৪ -বঙ্গাব্দ কার্তিক ৫, ১৩৬১ ) সালে মৃত্যু বরণ করেন।