রবীন্দ্রনাথকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার সবচেয়ে বড়ো গুণ কি? তিনি জবাব দিয়েছিলেন Inconsistency। তারপর জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার সবচেয়ে বড়ো দোষ কি?' রবীন্দ্রনাথ একই জবাব দিয়েছিলেন, ‘Inconsistency'। এই উত্তরের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যের মূল চাবি রয়ে গেছে। পারম্পর্যহীনতা রবীন্দ্রনাথ ফলিয়েছেন ষাট বছরের অধিক কাল ধরে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কাব্যনাট্যসাহিত্যের সকল মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন, কিন্তু সেখানেও তিনি কখনো এক জায়গায় থাকেননি। কবিতার বইগুলো একটি-আর একটির অনুরূপ নয় ; ছোটোগল্পের প্রথম পর্যায় আর শেষপর্যায় একরকম নয় ; প্রবন্ধ কী নিয়েই-না লিখেছেন ; লক্ষ্মীর পরীক্ষার সঙ্গে ডাকঘর কাব্যনাট্যের মিল নেই কোনো ; গোরা উপন্যাসের সঙ্গে শেষের কবিতা উপন্যাসের ব্যবধান আকাশপাতালের। আর লিখেছেন কীভাবে?—কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক—এসব অনেক সময় একই সঙ্গে লিখেছেন। অন্তহীন কাজ। পারম্পর্যহীন কাজ। যদি পরম্পরাহীনই হয়, অসংলগ্নই হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথের এত মূল্য কেন? কেন রবীন্দ্রনাথকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ? এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছি, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে। মেঘনাদবধ কাব্য-এর প্রভাবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে শ'দুয়েক মহাকাব্য রচিত হয়েছে ; কিন্তু মাইকেলের প্রভাব কেবল প্রকরণে নয়—কবিতার অন্তরাত্মায় আজো প্রবাহিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মানসীর প্রভার যে বাংলা সাহিত্যে আরো ব্যাপক—গভীর, তা আমরা লক্ষ্যই করি না। সেজন্যই ১৯৯০ সালে মানসী কাব্যের শতবর্ষ নিঃশব্দেই অতিক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশে ও পশ্চিম বাংলায়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’ কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে। ১৯৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বিষয়ে ঐ ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’ই কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। তখন গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও উপন্যাসের মহত্ত্ব। সেই উপলব্ধির কথাই কয়েকটি অনুচ্ছেদে এখানে বিবৃত করি। রবীন্দ্রনাথের প্রথম আত্মচারিত্রিক কবিতাগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের তিরিশ বছর বয়সে, ১৮৯০ সালে। আর তার সর্বশেষ আত্মচারিত্রিক কবিতাগ্রন্থ, শেষ লেখা প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে, ১৯৪১ সালে। এই পঞ্চাশ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ একটির পর একটি কাব্য প্রণয়ন করেছেন, যার কয়েকটি শিখরস্পর্শী, রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটির পর একটি তার প্রাক্তন শিখরচূড়া অতিক্রম করেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ (৩ আগস্ট ১৯৪৩ - ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য-সম্পাদক। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের "পোয়েট ইন রেসিডেন্স" ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশক থেকে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে তার গবেষণাধর্মী অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের উপর তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম রয়েছে। তিনি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বেগম রোকেয়া, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককে নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যমহলে তিনি 'মান্নান সৈয়দ' নামেই পরিচিত ছিলেন।