বাংলা প্রাইমারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা দুইশ বছরেরও বেশি সময়ের। সময়ের সাথে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের সক্রিয় প্রয়াস বাংলা প্রাইমারের গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। বাংলা প্রাইমার সমকালীন আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কারের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে এগিয়ে গিয়েছিল। আধুনিক বাংলা ভাষা-কাঠামো ও বাংলা প্রাইমার নিয়ে যারা যুক্ত হয়েছেন, তাদের আগ্রহের মূলে মাতৃভাষায় সর্বজনীন শিশুশিক্ষা তথা সামগ্রিক সমাজচিন্তার প্রভাব স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। আধুনিক বাংলা ভাষায় সর্বজনীন শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এক একটি প্রাইমার মাইলফলকের মতো কাজ করেছে। চিত্রায়ণ, অঙ্গসজ্জা, মুদ্রণকৌশল, প্রতীক নির্বাচন ও উপস্থাপন এবং সর্বোপরি বৃহত্তর পাঠকশ্রেণী নির্ধারণের মাধ্যমে বাংলা প্রাইমারের সার্বজনীন হয়ে ওঠার প্রবণতা আসলে এর সমকালীন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। হাতে লেখা পুঁথিনির্ভর কিংবা ধর্মীয় টোল-মক্তবকেন্দ্রিক গুরুমুখী শিক্ষার প্রথা থেকে সর্বজনীন বিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় উত্তরণে বাংলা প্রাইমারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরেও লেখাপড়া চর্চার কাজটি সহজ করে দেয় প্রাইমার। বিশেষত নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য ব্যাপক। আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশ ও প্রায়োগিক গবেষণা বাংলা প্রাইমারের বিকাশের সমান্তরালে এগিয়েছে। এই অঞ্চলে মুদ্রণ ও প্রকাশনার বিকাশে বাংলা প্রাইমারের ব্যবসায়িক সফলতার গুরুত্ব কম নয়। প্রাইমারের বাজার বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বিস্তার ঘটেছে ছাপাখানার সংখ্যা এবং মুদ্রণকৌশল। বাংলা প্রাইমারের সূচনা ও বিকাশকে বাঙলার নবজাগৃতির পটভূমিতে উপলব্ধি করার যথেষ্ট রসদ আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ইতিহাসের মূল্যবান দলিল হিসেবে সংরক্ষিত বা আলোচিত হয়নি। এ বিষয়ে আমার এই কাজটি বাংলা প্রাইমারের অবয়ব, চিত্রায়ণ ও মুদ্রণের পরিসরে সীমিত। এই প্রকাশনাটি নকশা ও মুদ্রণসংশ্লিষ্টদের কাছে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু বাংলা প্রাইমারের সামগ্রিক পর্যালোচনার পরিসর আরো অনেক বিস্তৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকাশনার সুবাদে যদি বাংলা প্রাইমারের বিষয়ে তরুণদের কৌতূহল সৃষ্টি হয়, আশা করব তা কেবল কারিগরি বিষয়েই সীমিত থাকবে না এবং এ বিষয়ে তাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাকে উৎসাহিত করবে। স্বজন ও সুহৃদদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা আমাকে এ ধরনের ভাবনা ও প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় অনুপ্রাণিত করেছে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার কারিগরি বিষয়ে সম্পূরক ধারণার জন্য এই প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে আমার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সাথে নিয়ে একটি প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছি। এর সবটাই ব্যক্তিগত প্রয়াসের ফল। কারিগরি দিকের বাইরে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বা অ্যাকাডেমিক নিরীক্ষার সুযোগ এক্ষেত্রে ছিল না। কার্যত প্রকাশনাটির মূল্যায়ন ও মানোন্নয়নে পাঠকের ওপরই নির্ভর করতে হবে। অতএব এ বিষয়ে যেকোনো সমালোচনা, পরামর্শ, সহযোগিতার অধিকার পাঠকের এবং পরবর্তী সংস্করণে ভুলত্রুটি সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধনের দায়িত্ব আমার। এই প্রেক্ষিতে সাফল্য এবং সীমাবদ্ধতাসহ প্রকাশনাটির অংশীদারিত্ব পাঠকের সাথে ভাগ করে কাজটিকে এগিয়ে নেওয়ার আশা রাখছি।