বর্তমানে, প্রায় সব মুসলিম দেশেই একটি মানসিক দ্বন্দ্ব এবং আরও সঠিক শব্দে, একটি মানসিক যুদ্ধ জারি আছে, যাকে আমরা ইসলামি চিন্তা ও মূল্যবোধ এবং পাশ্চাত্য চিন্তা ও মূল্যবোধের সংঘাত বা যুদ্ধ হিসেবে ব্যক্ত করতে পারি। এসব দেশের প্রাচীন ইতিহাস, ইসলামের প্রতি মুসলিম জাতিগুলোর হৃদয়াবেগ ও ভালোবাসা এবং যে নামে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে ও জয়লাভ করেছে বা যে শক্তিতে এসব দেশের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়েছে, সবই দাবি করে যে, এইসব ভূখণ্ডে শুধুমাত্র ইসলামি চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধেরই অধিকার রয়েছে এবং এখানে শুধুমাত্র সেই জীবনাদর্শের অনুসরণ করা বিধিত, ইসলাম যে জীবনাদর্শের আহ্বান করে। কিন্তু এর বিপরীতে, এই মুহূর্তে যে শ্রেণির হাতে এসব দেশের ক্ষমতা, তাদের মানসিক গঠন, শিক্ষা-দীক্ষা এবং ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থের দাবি হল এসব দেশে পশ্চিমা ধ্যানধারণা ও মূল্যবোধের বিকাশ এবং এই দেশগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর পদাঙ্ক অনুসরণ করানো; এবং ধর্মীয় ধারণা, জাতীয় রীতিনীতি, জীবনবিধান এবং আইন ও ঐতিহ্য যা কিছুই তাদের এই দাবিপূরণে প্রতিরোধক ও প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, তাতে সংশোধনী আনতে হবে কিংবা তা বাতিল করা হবে। সংক্ষেপে, দেশ ও সমাজকে অতি সন্তর্পণে, অথচ দৃঢ় সংকল্পের সাথে ‘পাশ্চাত্যায়ন’-এর ছাঁচে অভিযোজিত করা হবে। এই ক্ষেত্রে, কিছু দেশ এই যাত্রার একাধিক মনজিল ইতোমধ্যেই পার করে ফেলেছে, এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে প্রায় উপনীত হয়ে গেছে। আর কিছু দেশ এখনও ‘ক্রসরোডে’ রয়েছে; কিন্তু তাবৎ লক্ষণ ও সাক্ষ্য স্পষ্টভাবে সেই গন্তব্যমুখিতাই নির্দেশ করছে! আমার মতে, এটিই এই সময়ে মুসলিম দেশগুলোর সবচেয়ে বড় ও বাস্তবিক সমস্যা, ধারণাপ্রসূত বা কাল্পনানির্ভর নয় মোটেই। মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাব ও আগ্রাসন, (যার নজির মানবসভ্যতার ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যাবে) দেশগুলোর বৈষয়িক ও রাজনৈতিক শক্তি সকল মুসলিম দেশের সামনে এ বিষয়টি অত্যন্ত জ্বলজ্বলে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে উত্থাপন করেছে, যার উত্তর সবাইকে দিতে হবে এবং এই সংকেত ও অগ্রসর হওয়ার অনুমোদন ছাড়া কোনো দেশের যানবাহন এগিয়ে যেতে পারে না। পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি এই দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে এবং তাদের সমাজকে বর্তমান জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং যুগের বিরাজমান চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে তারা কোন পথ অবলম্বন করে এবং এক্ষেত্রে কতটা বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার প্রমাণ দিতে পারে- এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করে পৃথিবীর মানচিত্রে এসব জাতির গতিমুখ কী হবে এবং এসব দেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ কীরূপ হবে এবং তারা এই যুগে ইসলামের সর্বজনীন ও চিরন্তন পয়গামের জন্য কতদূর উপযোগী সাব্যস্ত হতে পারে।
আল্লাহর পথের এক মহান দাঈ,ইলমে ওহীর বাতিঘর যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী। খাঁটি আরব রক্তের গর্বিত বাহক।বিশ্বময় হেদায়েতের রোশনি বিকিরণকারী।উম্মতের রাহবর ও মুরুব্বি। কল্যাণের পথে আহ্বানে চিরজাগ্রত কর্মবীর। জন্ম ১৯১৪ ঈসাব্দে। ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সূতিকাগার উত্তর প্রদেশের রাজধানী লাখনৌর রায়বেরেলীতে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আদ্যোপান্তই দারুলউলুম নদওয়াতুল উলামায়। অধ্যাপনা জীবনের সিংহভাগও এই প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত ছিলেন। আল্লামা নদভীর খ্যাতির সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে "সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ" রচনার মাধ্যমে।গ্রন্থটি গোটা ভারতবর্ষে তাকে পরিচিত করে তুলে।এরপর তিনি রচনা করেন 'মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমিন' (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল) নামক কালজয়ী গ্রন্থ।যা তাকে প্রথমত আরববিশ্বে ও পরবর্রতীতে বৈশ্বিক সুখ্যাতি এনে দেয়। এ পর্যন্ত গ্রন্থটির শতশত সংস্করণ বের হয়েছে। বিগত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে তার কলম অবিশ্রান্তভাবে লিখেছে মুসলিম ইতিহাসের গৌরদীপ্ত অধ্যায়গুলোর ইতিবৃত্ত। সীরাত থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে দর্শন ও সাহিত্য পর্যন্ত সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। উর্দু থেকে তার আরবী রচনায় যেন অধিকতর অনবদ্য। আল্লামা নদভী জীবনে যেমন পরিশ্রম করেছেন, তেমনি তার শ্বীকৃতিও পেয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে খ্যাত বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুবাইয়ে তিনি বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের পক্ষ থেকে আলী নদভীকে সুলতান ব্রুনাই এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সদস্য ছিলেন। তিনি একাধারে রাবেতায়ে আলমে ইসলামী এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি ছিলেন। লাখনৌর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুলউলুম নাদওয়াতুল-উলামা' এর রেকটর ও ভারতীয় মুসলনমানদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম মুসলিম পারসোন্যাল ল' বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ইসলামের এই মহান সংস্কারক ১৯৯৯ সনের ৩১ ডিসেম্বর জুমার আগে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াতরত অবস্থায় ইন্তিকাল করেন।